সৈয়দ বোরহান কবীরআমাদের সৌভাগ্য আমরা শেখ হাসিনার মতো একজন প্রধানমন্ত্রী পেয়েছি। যিনি সারাক্ষণ মানুষের কথা ভাবেন, মানুষের জন্য কাজ করতে পছন্দ করেন। তাঁর প্রচুর উদ্ভাবনী জনকল্যাণমুখী চিন্তা আছে। সে চিন্তা বাস্তবায়নের জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেন। ১৯৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পায়। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন শেখ হাসিনা। এ সময় শেখ হাসিনা প্রান্তিক মানুষের জন্য অভাবনীয় এবং সৃষ্টিশীল কিছু পরিকল্পনা হাতে নেন। তিনিই প্রথম বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা বাংলাদেশে চালু করেন। বাংলাদেশই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে প্রথম যারা এ ভাতা চালু করে। দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধে থাকা একটি দেশ দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের জন্য আর্থিক সহায়তার সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। শেখ হাসিনা ১৯৯৬-২০০১ সাল মেয়াদে কমিউনিটি ক্লিনিক, একটি বাড়ি একটি খামার, আশ্রয়ণ এবং ঘরে ফেরার মতো যুগান্তকারী ‘সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী’র কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন। এই প্রতিটি উদ্যোগ অভূতপূর্ব, অনন্য এবং অসাধারণ। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে কমিউনিটি ক্লিনিক বন্ধ করে দেয়। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো ছাগল পালন কেন্দ্রে পরিণত হয়। বন্ধ হয়ে যায় একটি বাড়ি একটি খামার, আশ্রয়ণ প্রকল্প। ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করেন শেখ হাসিনা। দারিদ্র্য বিমোচনের সৃষ্টিশীল উদ্যোগগুলো আবার সচল হয়। উন্নয়ন সম্পর্কে আমাদের একটি ভুল ধারণা আছে। উন্নয়ন বলতে আমরা বুঝি রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, মেগা প্রজেক্ট। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নের পথে হাঁটা দেশগুলোর জন্য মানবিক উন্নয়নের চেয়ে দৃশ্যমান উন্নয়ন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। দৃশ্যমান মেগা উন্নয়ন ভোটের বাজারে মূল্যবান- এ রকম একটি মিথ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় প্রচলিত। এজন্যই বাংলাদেশে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল নিয়ে যত হইচই হয়, ততটাই নীরবতা পালন করা হয় কমিউনিটি ক্লিনিক, কিংবা আশ্রয়ণ প্রকল্প নিয়ে। অথচ এ উদ্যোগগুলো সত্যিকারের মানবিক উন্নয়ন করছে। একটা সমতা এবং সাম্যের রাষ্ট্র বির্নিমাণে অবদান রাখছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নে প্রায়ই অনীহা ও দায়সারাভাব লক্ষ্য করা যায়। অনেক সময় এসব ক্ষেত্রে দুর্নীতিরও অভিযোগ ওঠে। ভালো উদ্যোগ, সম্ভাবনাময় প্রকল্প দুর্নীতির ইঁদুর খেয়ে ফেলে। অথচ প্রধানমন্ত্রীর এ মানবিক উন্নয়নের উদ্যোগগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে পাল্টে যেত।
Bangladesh Pratidinএ ধরনের উদ্যোগ বাস্তবায়নে দুর্নীতিকে প্রধান বাধা মনে করা হয়। আর প্রান্তিক পর্যায়ে দুর্নীতির অভিযোগ সরাসরি ওঠে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে। বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা নিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার, উপজেলা চেয়ারম্যান এমনকি এমপিরা নয়ছয় করেন এমন অভিযোগ আগে প্রায়ই উঠত। বাংলাদেশে রাজনীতিবিদদের দুর্নীতিবাজ বলা একটি দায় এড়ানোর কৌশল। একটি রাস্তা দীর্ঘদিন হচ্ছে না কেন? এমপি সাহেবের জন্য। কীভাবে? তিনি টেন্ডার তার নিজের লোককে দিতে চাচ্ছেন। এজন্য টেন্ডার আটকে আছে। সরকারের ত্রাণ সহায়তা প্রকৃত দরিদ্র মানুষের কাছে পৌঁছেনি কেন? এমপি সাহেবের জন্য। কেন? উনি প্রকৃত দুস্থদের বদলে নিজের পছন্দের লোকদের নাম দিয়েছেন। গত দেড় বছরে সরকার নানারকম আর্থিক এবং নগদ সহায়তা দিয়েছে। আর এসব ক্ষেত্রে যে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে তা অধিকাংশই স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে। এজন্য অনেকে পদচ্যুত হয়েছেন, অনেককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ ত্রাণ, ভাতা, মানবিক উন্নয়ন প্রকল্পের দায়িত্ব জনপ্রতিনিধি বা রাজনীতিবিদদের দেওয়া ঠিক নয়, তারা দুর্নীতি করবেন- এ রকম একটি ধারণা সমাজমস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেওয়ার নিবিড় প্রয়াশ এখন সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে। রাজনীতিবিদরা দুর্নীতিগ্রস্ত তাই সব কর্মকান্ড থেকে তাদের সরিয়ে আমলাদের পাদপ্রদীপে নিয়ে আসা হলো। আমলারা সাধু, আমলারা দেবদূত। তাদের দায়িত্ব দিলে তারা চুরি করবেন না। ব্যস, জেলায় এমপিদের আইসোলেশনে নিয়ে, জেলা প্রশাসককে সিংহাসনে বসানো হলো। জেলা প্রশাসককে দেখভাল করবেন সচিব। বিরাজনীতিকরণের এমন প্রক্রিয়া এখন দেশে চলছে। কিন্তু এ মা, এ কী দেখছি! সুযোগ পেলে তো আমলারা একেবারে পুকুরচুরি করতে সিদ্ধহস্ত। তার প্রমাণ পাওয়া গেল প্রধানমন্ত্রীর আবেগ এবং ভালোবাসার উদ্যোগ আশ্রয়ণে। মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগ নিলেন গৃহহীন মানুষকে গৃহ দেওয়ার। ২ শতাংশ জমির ওপর সুন্দর পরিপাটি একটি দুই রুমের বাসা। একজন নিঃস্ব, রিক্ত মানুষ যেন মর্যাদা পেল, মানুষ হিসেবে তার আত্মপরিচয়, ঠিকানা এবং সম্মান পেল। প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পটি মুজিববর্ষের আগে গুরুত্বহীন ছিল। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস অর্থনীতির ছাত্র। পিএইচডি করেছেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। তিনি আশ্রয়ণ প্রকল্পকে লাইমলাইটে আনলেন। একে ড. কায়কাউস দেখলেন ‘অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন’-এর মডেল হিসেবে। প্রধানমন্ত্রীর আকাক্সক্ষা ও স্বপ্ন বাস্তবায়নে তিনি কার্যকরে বিশেষ উদ্যোগ নিলেন। বাংলাদেশে রাজনীতিবিদরা কিছু করতে চাইলে পদে পদে বাধার মুখে পড়েন। আমলাতন্ত্রের দৌরাত্ম্যে সুন্দর উদ্যোগ চাপা পড়ে যায়। কিন্তু আমলারা চাইলে তা হবে না, তাতে অসম্ভব। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের নির্দেশনা বাস্তবায়নে ঝাঁপিয়ে পড়ল মাঠ প্রশাসন। অভিন্ন নকশায় ১ লাখ ২৩ হাজার বাড়ি নির্মিত হয়ে গেল। আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহও হস্তান্তর করা হলো। প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন মুজিববর্ষে সব গৃহহীন মানুষকে একটি করে গৃহ দেওয়া হবে। সেই স্বপ্ন পূরণের দ্বারপ্রান্তে যখন বাংলাদেশ তখনই আচমকা বিনা মেঘে বজ্রপাতের ঘটনা ঘটল। প্রথমে গণমাধ্যমগুলো ইনিয়ে-বিনিয়ে লিখল কিংবা দেখাল ঘরগুলো ভেঙে পড়ছে। এরপর সবার সহ্যের বাঁধ ভেঙে পড়ল। একের পর এক উপহারের গৃহ ধসে পড়ার ঘটনায় কেবা চোখ বুজে থাকতে পারে। কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরোল। ২২ জেলার ৩৬ উপজেলায় (নাকি আরও বেশি?) গৃহ নির্মাণে নানা অনিয়মের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। অনিয়ম এবং দুর্নীতির অভিযোগে পাঁচজন সরকারি কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়েছে। পাঠক, এ গৃহ উপহার দেওয়া কিংবা ‘থাকবে না কেউ গৃহহীন’ উদ্যোগটি একটি রাজনীতিমুক্ত উদ্যোগ। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এর সবকিছু আমলারা করেছেন। গৃহ বানানোর তদারকি করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা। একটু ভাবুন তো, এ কাজ যদি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা করতেন আর একটি গৃহও যদি ভেঙে পড়ত তাহলে ওই উপজেলা চেয়ারম্যানকে বা জনপ্রতিনিধিকে কোমরে দড়ি বেঁধে জেলে নিয়ে যাওয়া হতো। সারা দেশে রাজনীতিবিদদের চুরি নিয়ে কত গল্প মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ত। প্রধানমন্ত্রীর একটি স্বপ্ন বাস্তবায়নেও রাজনীতিবিদরা লোভ সামলাতে পারেন না- এমন কথা বলে আর্তনাদ করতেন দেশের সুশীলরা। অথচ আমলারা এ রকম অপকর্ম করে স্রেফ ওএসডি হলেন। এদের বিরুদ্ধে এখন বিভাগীয় মামলা হবে। তারপর তারা নানা কৌশলে আবার ক্ষমতার কেন্দ্রে যাবেন, দ্রুত পদোন্নতি পাবেন। আশ্রয়ণ প্রকল্পের ‘গৃহ উপহার’ উদ্যোগ একটি সত্যের সামনে আমাদের দাঁড় করায়; তা হলো দুর্নীতিতে এখন আমলারাই চ্যাম্পিয়ন। কেবল ‘ক্ষমতা’র দৌড়ে নয় দুর্নীতির দৌড়েও আমলারা রাজনীতিবিদদের অনেক পেছনে ফেলে দিয়েছেন। এ রকম উদ্যোগে যদি এমপি বা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থাকতেন তাহলে তারা ‘প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে’ চুরি করার সাহস পেতেন না। আওয়ামী লীগের ত্যাগী, পরীক্ষিত আদর্শবান নেতারা নিজেরা দাঁড়িয়ে এসব গৃহ নির্মাণ তদারকি করতেন। করোনাকালে আমরা দেখেছি আওয়ামী লীগের কর্মীরা ধান কেটে দিয়েছেন, নিজ উদ্যোগে ত্রাণ দিয়েছেন। এ ঘটনা আমলাদের অপকীর্তির প্রথম এবং একমাত্র নমুনা নয়। প্রধানমন্ত্রীর মানবিক চিন্তার আরেকটি অভাবনীয় উদ্যোগ ছিল ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ (বর্তমানে এ প্রকল্পের নাম ‘আমার বাড়ি আমার খামার)। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেলে এ প্রকল্প গতি পায়। সে সময় প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ছিলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী। সৎ এবং আদর্শবান রাজনীতিবিদ, কিন্তু গুটিয়ে থাকা মানুষ। ওই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছিলেন জাহাঙ্গীর কবির নানক। তিনি দায়িত্ব নিয়েই ‘একটি বাড়ি একটি খামার’কে বিশেষ গুরুত্ব দেন। এ সময় ওই প্রকল্পের পরিচালক হন এক আমলা। তিনি এমন হরিলুট করেন যে প্রকল্পের নামই দুর্নীতির কারণে পাল্টে যায়। সবাই বলা শুরু করেন ‘একটি বাড়ি একটি খামার, অর্ধেক আমার অর্ধেক তোমার’। একজন আমলার লোভে মুখ থুবড়ে পড়ে প্রকল্পটি। নানক ওই প্রকল্প পরিচালককে বারবার সতর্ক করেছিলেন। তার পরও তাকে প্রকল্পের দায়িত্ব থেকে সরাতে পারেননি। অবশ্য ওই আমলাকে এজন্য জেলে যেতে হয়নি, কোনো শাস্তিও পেতে হয়নি। বরং পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সে সময় ক্ষমতাবান এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী এক আমলার আনুকূল্যে তিনি সচিবও হয়েছিলেন। কিন্তু আমলা বলে কথা। আমলারা যেন হাঁস। পানিতে ডুবে গা ঝাড়া দিলেই হলো, তিনি পূতপবিত্র। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একেক সময় একেক আমলা ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেন। তার ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় অনেক কিছুই হয়। ওই সময় সবচেয়ে ক্ষমতাধর এক আমলার আনুকূল্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সচিব হয়েছিলেন একজন। ত্রাণ বিতরণসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল তার বিরুদ্ধে। ওই সময় প্রধানমন্ত্রী ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে যেতেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজে ওই আমলাকে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু তাতে কী? বহাল তবিয়তে রাজত্ব করে তিনি বিদায় নিয়েছেন। গত সোমবার (৫ জুলাই) স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ আমলা এক অভাবনীয় আবিষ্কার করলেন। মৃত ব্যক্তিকে জীবিত বানানোর মতো দুর্দান্ত আবিষ্কারের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ববান আমলা কী পুরস্কার পাবেন তা বুঝতে পারছি না। করোনা মোকাবিলার জন্য ওই শীর্ষ আমলা একযোগে বার শর বেশি চিকিৎসককে বদলির সিদ্ধান্ত নিলেন। ভালো কথা। এ বদলি আদেশে কয়েকজন মৃত ডাক্তার জীবিত হয়ে উঠলেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওই কর্তার কাজ দেখে মনে হলো তিনি যেন অনন্ত জলিল। ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে এক্ষুনি বলবেন ‘অসম্ভবকে সম্ভব করাই আমার কাজ’। করোনাকালের আগে চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের অহংকার এবং ঔদ্ধত্য বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গিয়েছিল (সেজন্যই হয়তো করোনা প্রকৃতির প্রতিশোধ)। নব্বইয়ের দশক থেকেই চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা অমরত্বের সন্ধানে নানা গবেষণা করছিলেন। ১৯৯২ সালে স্কটল্যান্ডের গবেষক ড. আয়ান উইলমুট রোজালিন ইনস্টিটিউটে ২৭৩তম চেষ্টায় জীব ক্লোনিংয়ে সফল হন। ‘ডলি’ নামের ভেড়ার জীব ক্লোনিংয়ের বিস্ময়কর সাফল্য। এ ধারায় মানব ক্লোনিংয়ের গবেষণাও চলছে চুপিসারে। আবার মার্কিন চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা স্টেমসেলের উদ্ভাবন করে বয়সকে আটকে রাখার চেষ্টায় দিনরাত কাজ করছেন। কিন্তু কোনো দেশের চিকিৎসাবিজ্ঞান বা স্বাস্থ্য খাত মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করতে পারেনি। বাংলাদেশের আমলারা পেরেছেন। বগুড়া মেডিকেল কলেজের বক্ষব্যাধি বিভাগের প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক ছিলেন ডা. জীবেশ কুমার প্রামাণিক। গত জানুয়ারিতে তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। কিন্তু ৫ জুলাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আমলারা তাকে সফলভাবে জীবিত করে নতুন করে পদায়ন করেছেন। কি বিস্ময়কর আবিষ্কার! কি অপরিসীম ক্ষমতা আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। শুধু ডা. জীবেশ একা নন, এ রকম বেশ কয়েকজন চিকিৎসক ‘জীবিত’ হয়েছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাগজের ছোঁয়ায়। যিনি এ রকম অসাধ্যসাধন করেছেন সেই আমলা কদিন আগে পদোন্নতি পেয়ে সেরাদের সেরা হয়েছেন। সচিব থেকে তিনি সিনিয়র সচিব হয়েছেন। বিরল প্রতিভার এ আমলা সম্পর্কে একটু খোঁজ নিয়ে দেখলাম তিনিও সদ্য ওএসডি হওয়া খুদে আমলাদের মতো বিভাগীয় তদন্তের মুখোমুখি হয়েছিলেন। ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক থাকা অবস্থায় তার বিরুদ্ধে একটি অতি গোপনীয় এবং স্পর্শকাতর অভিযোগ নিষ্পত্তির দায়িত্ব পেয়েছিলেন সে সময়ের ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার। তদন্তে তিনি ‘বেকসুর’ প্রত্যয়নপত্র পান। কদিন আগেও রোজিনা ইস্যুতে আলোচিত হন ওই আমলা। তার অফিসকক্ষে একজন সংবাদকর্মীকে আটকে রাখার পুরস্কার পান একেবারে নগদে। সচিব থেকে সিনিয়র সচিব হয়ে যান। এখন মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করার অসাধ্যসাধন করে নিশ্চয়ই তিনি আরেকবার পুরস্কৃত হবেন। কাজেই যেসব বালক আমলারা প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নকে ধূসর করেছেন, গৃহহীনদের গৃহ বানানোর কাজে নয়ছয় করেছেন তাদের আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। নিশ্চয়ই তারা অদূর ভবিষ্যতে তরতর করে ক্যারিয়ারের গ্রাফ ওপরের দিকে নিয়ে যাবেন। এতে বরং তাদের দ্বিমুখী লাভ হবে। প্রথমত বিচার বিভাগীয় তদন্তে দেখা যাবে তাদের কোনো দোষ নেই। দুষ্টু ঠিকাদাররা এসব করেছেন। ইউএনওর তো অনেক কাজ। রড, সিমেন্ট, বালু এসব দেখা কি তার পক্ষে সম্ভব? ব্যস, এরপর নতুন জায়গায় তার পোস্টিং হবে। দ্বিতীয়ত এ সরকার যখন চলে যাবে বিএনপি-জামায়াত, জাতীয় পার্টি, সুশীল যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন এই ছোটবাবুরা কেঁদে কেটে বলবেন, আমরা তো নির্যাতিত ছিলাম। এই যে আমাদের ওএসডি করেছিল। বিএনপি-জামায়াত এলে তো কথাই নেই। তারা তখন জিয়া কিংবা ভাইয়ার সৈনিক হয়ে যাবেন। তারপর বুক ফুলিয়ে বলবেন, ‘শেখ হাসিনার গৃহদান’ কর্মসূচিকে আমরা চাকরির ঝুঁকি নিয়ে ভেস্তে দিয়েছি। এখন যেমন উচ্চপদে থাকা এক আমলা ছাত্রদল করতেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর একান্ত সচিব হয়েছিলেন। (তখন মন্ত্রীদের একান্ত সচিব করা হতো রাজনৈতিক বিবেচনায়)। দুর্নীতির দায়ে বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে সাসপেন্ড হয়েছিলেন। ওই শাস্তি ছিল তার জন্য আশীর্বাদ। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ওই শাস্তি দেখিয়ে তিনি হয়ে যান নির্যাতিত। সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুভাগ্য যুক্ত হয়। তাকে আর ঠেকায় কে? এখন তিনি শীর্ষ কর্তা এক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের। কাজেই দুর্নীতি করুক, অনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ুক, আমলাদের কোনো সমস্যা নেই। প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন ধূসর করলেও তাদের শাস্তি হয় না। গৃহহীন মানুষের গৃহ বানাতে অনিয়ম করলেও তাদের কোনো দোষ নেই। সরকার পরিচালনায় নেতৃত্বে যেমন আমলারা রাজনীতিবিদদের হটিয়ে দিয়েছেন তেমনি দুর্নীতিতেও এখন আমলাদের কাছে পরাজিত রাজনীতিবিদরা। তবে একজন রাজনীতিবিদ যখন দুর্নীতি করেন তখন তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার হুমকির মুখে পড়ে। দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে একজন রাজনীতিবিদ কখনো জনগণের নেতা থাকতে পারেন না। কিন্তু আমলাদের জন্য এ ধরনের অভিযোগ এবং বিতর্ক তাদের জন্য আশীর্বাদ। এ যেন তাদের ভবিষ্যৎ উন্নতির বহুমুখী সুযোগ ও সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়। প্রধানমন্ত্রীর অসাধারণ চিন্তাশীল উদ্যোগের কথা বলেছিলাম শুরুতে। প্রধানমন্ত্রীর এ উদ্যোগগুলো বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্র, চিন্তা, দর্শন থেকে উৎসারিত। এই প্রতিটি উদ্যোগের একটি রাজনৈতিক ভাবনা আছে। রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ছাড়া এ উদ্যোগগুলো সফল হতে পারে না। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো গৃহহীনদের গৃহ ভেঙে পড়া। আবার রাজনৈতিক উদ্যোগ এবং নেতৃত্ব থাকলে যে শেখ হাসিনার উদ্যোগ সফল হয় তার বড় প্রমাণ কমিউনিটি ক্লিনিক। করোনাকালে গোটা দেশের স্বাস্থ্য খাত যখন আকণ্ঠ দুর্নীতিতে ডুবে আছে তখন দেশের ১৩ হাজারের বেশি কমিউনিটি ক্লিনিক যেন আশ্চর্য ব্যতিক্রম। তারা নীরবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার কাজটা করে যাচ্ছে। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো পরিচালিত হচ্ছে কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের তত্ত্বাবধানে। এ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী একজন রাজনীতিমনস্ক মানুষ। ছাত্রলীগ করেছেন, ওয়ান-ইলেভেনে বিরাজনীতিকরণের বিরুদ্ধে লড়েছেন। মাঠপর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিকের নেতৃত্বে ‘কমিউনিটি গ্রুপ’। জনগণের ক্ষমতায়নের এ মডেলটি দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় নীরব বিপ্লবে নেতৃত্বে দিচ্ছে। এর কারণ এর কর্তৃত্ব রাজনীতিসংশ্লিষ্ট মানুষ ও জনগণের হাতে। এ দুই পার্থক্য থেকেই আমরা বলতে পারি, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া শেখ হাসিনার স্বপ্নগুলো আমলাতন্ত্রের হাতে গেলে কেবল বিবর্ণ, মলিন এবং ধসেই পড়বে।
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।
ইমেইল : poriprekkhit@yahoo.com