এস এম আজাদ জাল নোট তৈরির চক্রগুলো বছরজুড়ে সক্রিয় থাকলেও কোরবানির পশুর হাট ঘিরে বাড়তি তৎপরতা চালিয়ে থাকে। বরাবরের এই অপতৎপরতা থেমে থাকেনি এবারও। করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর লকডাউনের মধ্যেও চলেছে জাল নোটের হাতবদল। এর মধ্যে কয়েক কোটি টাকার জাল নোট ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে রাজধানীতে। এমন তথ্য পেয়ে কোরবানির পশুর হাটে জাল নোট শনাক্তের মেশিন স্থা্পনসহ সতর্কতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
র্যাব ও পুলিশের নজরদারিতে সম্প্রতি র্যাব-পুলিশের হাতে জাল নোট চক্রের বেশ কিছু সদস্য গ্রেপ্তারের পর তদন্তে এমন তথ্য উঠে এসেছে। বাসা ভাড়া নিয়ে গোপনে জাল নোট তৈরির সিন্ডিকেটে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, ইয়াবাসহ মাদক কারবারি, হাসপাতালের দালাল, চোরাকারবারি, গার্মেন্ট ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ। সারা বছর মাদকের লেনদেন, চোরাই পণ্যের কারবার, সোনা বেচাকেনাসহ বিভিন্ন অবৈধ লেনদেনে জাল নোট চালিয়ে দেয় ওরা। আর কোরবানির পশুর হাটের ভিড়ে ওরা আরো বেশি তৎপর হয়ে ওঠে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাল নোট ছাপা ও বাজারে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় চক্রগুলোর প্রায় অর্ধশত সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হলেও তারা বারবার জামিনে বেরিয়ে যায়। আবার একই কারবারে জড়িয়ে পড়ে। সর্বশেষ গত বুধবার রাজধানীর মোহাম্মদপুরে জাল টাকা ও ইয়াবাসহ হাসপাতালের দালালচক্রের হোতা মামুনসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
গত বছর রিজেন্ট হাসপাতালে চিকিৎসার নামে প্রতারণা করা সাহেদের অফিসে অভিযান চালিয়েও এক লাখ ৪৬ হাজার জাল টাকা উদ্ধার করে র্যাব। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে অপরাধীচক্রের কাছ থেকে জাল নোট জব্দ করার ঘটনাও ঘটেছে। দ্রুত গোপনে অচেনা কারো সঙ্গে অবৈধ পণ্যের বেচাকেনা করতে গিয়ে জাল নোট দিয়ে প্রতারণা করে চক্রগুলো।
গত সোমবার বাড্ডা থানাধীন নুরেরচালা সাঈদনগরে একটি সাততলা বাড়ির ষষ্ঠতলায় অভিযান চালিয়ে ৪৩ লাখ টাকার জাল নোট ও নোট তৈরির সরঞ্জামসহ আবদুর রহিম শেখ ও তার স্ত্রী ফাতেমা বেগম, গার্মেন্ট ব্যবসায়ী হেলাল খান, আনোয়ার হোসেন ও ইসরাফিল আমিনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। ভাড়া বাসায় স্বামী-স্ত্রী এই জাল নোটের কারখানা তৈরি করেন। ফাতেমা ২০১৯ সালে হাতিরঝিল এলাকার একটি বাসায় জাল নোট তৈরির সময় সহযোগীসহ ধরা পড়লেও তাঁর স্বামী রহিম পালিয়ে যান। জামিনে ছাড়া পেয়ে এই নারী আবারও স্বামীর সঙ্গে মিলে জাল নোট তৈরি করে তা বাজারে ছাড়তে শুরু করেছিলেন।
অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া ডিবির ডিসি (গুলশান) মশিউর রহমান বলেন, হেলাল খান একসময় গার্মেন্টের ব্যবসা করলেও পরে ইয়াবার কারবার শুরু করেন। তিনি রহিম ও ফাতিমাকে দিয়ে জাল নোট তৈরির অপতৎপরতা চালাচ্ছিলেন। বিপণিবিতান ও কোরবানির পশুর হাটে জাল নোট ছড়ানোই ছিল তাদের টার্গেট। এ জন্য কোটি টাকার নোট তৈরির প্রস্তুতি নিয়েছিলেন তাঁরা।
পুলিশ সূত্র জানায়, কঠোর লকডাউনের সময়ও জাল নোট ছড়ানোর তথ্য পাওয়া গেছে। গত ৫ জুলাই রাতে মিরপুরের শহীদ সোহরাওয়ার্দী ইনডোর স্টেডিয়াম এলাকায় চেকপোস্টে তল্লাশি করছিল পুলিশ। সেখান থেকে মীর ফজলে রাব্বী ও মোহসীন ইসলাম নামের দুই যুবকের দেহ তল্লাশি করে প্রায় এক লাখ টাকার জাল নোট পাওয়া যায়। তাঁরা এসব নোট বিক্রির জন্য নিয়ে যাচ্ছিলেন।
পল্লবী থানার ওসি পারভেজ ইসলাম বলেন, করোনার মধ্যেও জাল নোট তৈরি করে প্রতারকরা তা ঈদের বাজারে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। গ্রেপ্তার দুজনের বিরুদ্ধে পল্লবী থানায় মামলা হয়েছে। তদন্ত চলছে।
এর আগে গত ২২ জুন বাড্ডা থেকে নাইমুল হাসান তৌফিক নামের এক তরুণকে ৫০ লাখ টাকার জাল নোটসহ গ্রেপ্তার করে র্যাব। র্যাব ১০-এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মাহফুজুর রহমান বলেন, তিন বছর ধরে জাল নোটের কারবারে জড়িত তৌফিক একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র। এই চক্রের আরো দুজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। ওরা এক লাখ টাকার জাল নোট ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে। এর মধ্যে শতাধিক চালানে ওরা কয়েক কোটি টাকার জাল নোট বাজারে ছেড়ে দিয়েছেন।
তিনি জানান, চক্রটি কোরবানির পশুর হাটে টার্গেট করে ব্যাপকভাবে জাল নোট চালানোর চেষ্টা করা হয়। ব্যাপারীরা অনেকেই জাল নোট চিনতে পারে না। ভিড়-ব্যস্ততাও থাকে বেশি। আর সেই সুযোগ নেন কারবারিরা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, ‘জাল নোট কারবারিদের বিরুদ্ধে অভিযানের পাশাপাশি রাজধানীর পশুর হাটসহ বিভিন্ন স্থানে আমাদের নজরদারি থাকবে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তায় জল নোট শনাক্তকারী যন্ত্রও বসানো হবে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জাল নোটের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। কোরবানির পশুর হাটেও বরাবরের মতোই নজরদারি থাকবে।’