নিজস্ব প্রতিবেদকবাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ‘অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর’ ছিলেন মো. আবদুল মালেক (৪২)। বিভিন্ন সময় দুর্নীতি করার অপরাধে ২০১৫ সালে চাকরিচ্যুত হন। প্রশ্নপত্র ফাঁস, পরীক্ষায় চিপস ব্যবহার, বিভিন্ন কোটার জন্য নকল সার্টিফিকেট তৈরি করে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার নাম করে এরই মধ্যে বনে গেছেন শত কোটি টাকার মালিক। সম্প্রতি প্রতারণার শিকার একাধিক ভুক্তভোগীর অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে রবিবার দিবাগত রাতে রাজধানীর তেজগাঁও থানাধীন মনিপুরীপাড়া এলাকা থেকে মো. আবদুল মালেককে গ্রেফতার করে র্যাব-৪। এ সময় তার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত জাল সনদপত্র ও বিভিন্ন নথিপত্র। গতকাল দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়ে র্যাব-৪-এর অধিনায়ক মোজাম্মেল হক বলেন, প্রতারক এই চক্রের মূলহোতা মো. আবদুল মালেক। এই চক্রের পলাতক আরও তিন সদস্য আবদুর রাজ্জাক (৫০), আল-আমিন (২৫) ও অবিনাষ (৩২) মিলে সরকারি চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণা করে আসছিল। আমরা চক্রের বাকি তিন সদস্যকে গ্রেফতারের চেষ্টা করছি। র্যাব বলছে, মালেক প্রতারণার মাধ্যমে অনেক সম্পত্তি ও টাকার মালিক হয়েছেন। তার নামে বিভিন্ন ব্যাংকে একাধিক অ্যাকাউন্টে ৫০ লাখ টাকার বেশি এফডিআর রয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা জেলার ধামরাই থানাধীন ফোর্ডনগর এলাকায় ৮ দশমিক ২৫ শতাংশ জমি রয়েছে। রাজধানীর মনিপুরী এবং ৬০ ফিট এলাকায় তার তিনটি ফ্ল্যাট রয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য ১ কোটি টাকা। কুষ্টিয়া সদর থানাধীন বড়িয়া এলাকায় জাহান সুপার মার্কেট ছাড়াও নিজ গ্রামে ২৫ বিঘা জমি এবং একটি পাকা বাড়ি রয়েছে। কুষ্টিয়ায় তার জাহান গ্রুপ নামে একটি কনজুমার প্রোডাক্ট কারখানা রয়েছে। কুষ্টিয়া এক্সপ্রেস নামে একটি বাস ও চারটি ট্রাক রয়েছে তার। প্রতারক মালেকের উত্থান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১৯৭৯ সালে কুষ্টিয়ায় জন্ম নেওয়া মালেক ১৯৯৩ সালে দাখিল এবং ১৯৯৫ সালে আলিম পাস করেন। এরপর স্থানীয় একটি কলেজ থেকে বিকম এবং এমকম ডিগ্রি পড়েন। ২০০৪ সালে তিনি বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর খামারবাড়ী, ফার্মগেটে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে চাকরি শুরু করেন। এরপর থেকে চাকুরি প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতারণা করে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিতে থাকেন। একপর্যায়ে ২০১০ সালে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে তাকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর তার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের সত্যতা পেলে ২০১৫ সালে তাকে চাকরিচ্যুত করে। প্রতারণার কৌশল সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রথমে সে নিজ এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় এজেন্ট নিয়োগ করে চাকরিপ্রার্থীদের সংগ্রহের কাজ শুরু করেন। তারপর সরকারি চাকরি প্রার্থীদের প্রলোভন দেখানোর জন্য ২০১৬ সালে ‘এমভিশন’ নামে একটি কোচিং সেন্টার চালু করেন। সেখানে চাকরি প্রার্থীদের মধ্যে থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের কোটা (জেলা কোটা, প্রতিবন্ধী কোটা, মুক্তিযোদ্ধা কোটা, এতিম কোটা, আনসার কোটা) শ্রেণিকরণ করত। সেই তালিকা অনুযায়ী প্রার্থীদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করত। স্ট্যাম্পে চুক্তির মাধ্যমে টাকা অথবা জমির দলিল জমা রাখার শর্তে চাকরি প্রার্থীদের সঙ্গে তিনি চুক্তিবদ্ধ হন। চুক্তি শেষে বিভিন্ন মাধ্যম যেমন-লিখিত পরীক্ষায় প্রার্থীর ছবি পরিবর্তন/প্রশ্নফাঁস/প্রার্থীকে ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে পাস করানো হতো। এরপর নাগরিক সনদপত্র পরিবর্তন, জন্মসনদ পরিবর্তন, চারিত্রিক সনদপত্র, এতিমখানার সনদপত্র, প্রতিবন্ধী সনদপত্র, চেয়ারম্যান প্রত্যয়নপত্র পরিবর্তনসহ যে সব জেলায় অধিক সংখ্যক জনবল নিয়োগে উল্লেখ থাকে জাতীয় পরিচয়পত্রে সে সব জেলার প্রার্থীর ভুয়া নাম ঠিকানা ব্যবহার করা হতো। কোনো চাকরি প্রার্থী চুক্তি অনুযায়ী টাকা দিতে না পারলে তাদের জমা রাখা জমির দলিলের মাধ্যমে প্রার্থীর জমি দখল করে নিত। যারা এই প্রক্রিয়ায় চাকরি পেত তাদেরকে জিম্মি করার জন্য তাদের সব ধরনের কাগজপত্র জমা রাখত। পরবর্তীতে তাদের কেউ ঝামেলা করলেই তার বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট দফতরে ভুয়া নাম ঠিকানা ব্যবহার করে চাকরি পাওয়ার অভিযোগ দেওয়া হতো।