নিজস্ব প্রতিবেদকরাজধানীর অভিজাত পাড়ায় সর্বনাশ করছে মাদক। নিজেদের ভাড়া করা বাড়িতে ভয়ংকর চক্র মাদকের আসর বসাচ্ছে। করছে ব্ল্যাকমেল। এসব অপকর্মের জন্য গুলশান, বনানী, বারিধারা, উত্তরাসহ বিভিন্ন এলাকায় নাইট ক্লাবের আদলে গড়ে উঠেছে অসংখ্য সিসাবার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে এসব আস্তানা। এসব স্থানে হাউস পার্টি বা ডিজে পার্টির আয়োজন করা হয়। চক্রের খপ্পরে পড়ে বিত্তশালীর সন্তানরা পার্টিতে গিয়ে বিপথে চলে যাচ্ছে।
ইতিমধ্যে এই চক্রের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা। অভিযানের পর একে একে এই চক্রের সঙ্গে জড়িত শতাধিক নাম বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। মাদকের আস্তানা, নাইট ক্লাব আর সিসাবারগুলো গুঁড়িয়ে দিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জিরো টলারেন্স অবস্থান নিয়েছে। ব্ল্যাকমেলিংয়ের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান এখন কঠোর। এসব ঘটনার আলামত হিসেবে উদ্ধার করা অডিও-ভিডিও ফুটেজ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছে এই ভিন্ন জগতের আদ্যোপান্ত।
সূত্র জানায়, চট্টগ্রামের মেয়ে মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসার আরেক গডফাদারের নাম উঠে এসেছে গোয়েন্দাদের তদন্তে। সরকারি দলের হুইপপুত্র নাজমুল করিম চৌধুরী শারুনের নাম উঠে আসে। পিয়াসা এবং শারুনের বাড়ি চট্টগ্রামে হওয়ায় অনেক আগে থেকেই দুজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। পিয়াসার পরিবারের আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো নয়। ঢাকায় আসার পর বিভিন্নভাবে তাকে সহযোগিতা করতে থাকে তার বন্ধু শারুন। পিয়াসা মডেলিং করার নামে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন, যাদের কাজই হলো কোটিপতি ব্যক্তিদের টার্গেট করে তাদের ব্ল্যাকমেল করা। পিয়াসার মাদক, অস্ত্র আর ব্ল্যাকমেলিংয়ের পেছনে মিশু হাসান ছাড়াও এই শারুনও রয়েছে বলে তদন্তে পাওয়া গেছে।
উল্লেখ্য, মাদক ব্যবহার ও ব্ল্যাকমেলিংয়ের অভিযোগে ইতিমধ্যে গ্রেফতার করা হয় আলোচিত মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা, মরিয়ম আক্তার মৌ, চিত্রনায়িকা পরীমণি, নজরুল রাজ, মিশু, জিসান এবং জিমিকে। এদের প্রত্যেকের বাসায় রয়েছে মিনিবার। উদ্ধার করা হয়েছে বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদ, সিসা, এলএসডি, ইয়াবা, আইসসহ পর্নো ছবি তৈরির বিভিন্ন সামগ্রী। পার্টির নামে বিত্তবানদের বাসায় ডেকে এনে মদ ও ড্যান্স পার্টির ব্যবস্থা করত। এরপর আপত্তিকর ছবি তুলত এরা। বিত্তবানদের সন্তান, ব্যবসায়ী, ব্যাংকারসহ সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ডেকে নিয়ে ব্ল্যাকমেলিং করার আপত্তিকর ভিডিও ও ছবি গোয়েন্দারা খুঁজে পায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, হাউস পার্টির নামে মাদক কারবার, অনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িত শোবিজের শতাধিক মডেল-নায়িকার নাম পেয়েছে গোয়েন্দারা। তাদের অন্তত ১২ জনকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। যাচাই করা হচ্ছে হাউস পার্টির ফ্ল্যাটগুলোও। এসব চক্রের মাদক কারবারের নেটওয়ার্ক নিয়েও শুরু হয়েছে তদন্ত। দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, মাদকের পার্টির ও প্রতারণার পেছনে যারা আছেন তারা প্রভাবশালী হলেও আইনের আওতায় আনা হবে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, যারা গ্রেফতার হয়েছেন, তারা ইতিমধ্যে স্বীকার করেছে তারা ব্ল্যাকমেলিং চক্রের সদস্য। এ রকম শত শত রয়েছে চক্রের সদস্য। এরা দুটি কাজ করছে। একটা হলো তরুণ-তরুণীদের মাদকে আসক্তি করছে। আরেকটি হলো রাতে পার্টি আয়োজন করে অশ্লীল ছবি তুলে সেগুলো তার পরিবারের কাছে পাঠিয়ে হুমকি দিত। এদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। যারা এখনো গ্রেফতার হয়নি, তাদের ধীরে ধীরে আইনের আওতায় আনা হবে।
গোয়েন্দা সূত্র আরও জানায়, পিয়াসার নেটওয়ার্কে ২০-২৫ জন সুন্দরী রমণী রয়েছে। পালাক্রমে তাদের মাধ্যমেই বসানো হয় মাদকের জমজমাট আসর। সেই আসরে আমন্ত্রণ জানানো হতো গুলশান, বনানী, বারিধারায় বসবাসকারী ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও তাদের সন্তানদের। এতে তিন ধরনের ফায়দা হাসিল করত সে। আসরে আমন্ত্রিতদের বুঁদ করতে যে মাদক ব্যবহার করা হতো তার বিল পেত পিয়াসা। এ ছাড়া রমণীরা উদাম নৃত্যের সময় তাদের ওপর যে টাকা ছিটানো হতো তার বড় অংশও পিয়াসা নিত। আর গোপন ক্যামেরায় আসরে আগন্তুকদের ছবি তুলে ব্ল্যাকমেল করত। এ ছাড়া রমণীদের সঙ্গে রাত কাটানো অতিথিদের পরদিন গুলশানের একটি ডায়মন্ড জুয়েলারি শপ থেকে লাখ লাখ টাকার জুয়েলারি উপহার দিতে বাধ্য করত। পরে ওই জুয়েলারি ফেরত দিয়ে নগদ টাকা নিয়ে নিত পিয়াসা। তার সঙ্গে ওই ডায়মন্ড জুয়েলারি মালিকেরও ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। আর পিয়াসার নেটওয়ার্কে থাকা সদস্যদের ইয়াবার চালান আসত টেকনাফ থেকে। অভিনব কায়দায় সংগ্রহ করা হতো ওই চালান। যা গোয়েন্দাদের কাছেও অনেকটা অজানা। পিয়াসার ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা যায়, কয়েকজন বন্ধুর সহযোগিতায় একটি গরুর ফার্ম প্রতিষ্ঠা করেছে পিয়াসা। ওই ফার্মের জন্য টেকনাফ থেকে বার্মিজ গরু আনার সময় গরুর পেটে ঢুকিয়ে আনা হতো ইয়াবার চালান। এ কাজে পিয়াসার প্রধান সহযোগী হলো জিসান ও মিশু। সূত্র জানায়, ঢাকার অভিজাত এলাকায় অর্ধশতাধিক ফ্ল্যাটের সন্ধান পেয়েছে গোয়েন্দারা। এসব পার্টিতে ধনী পরিবারের সন্তানদের আমন্ত্রণ করে নিয়ে ক্ষতিকর মাদকে আসক্ত করা হয়। কতিপয় বিতর্কিত মডেল-নায়িকাদের দিয়ে আয়োজন করা হলেও অনৈতিক কারবারি এর সঙ্গে যুক্ত। পার্টির নামে ধনাঢ্যদের সঙ্গে সম্পর্ক করে এবং প্রতারণার ফাঁদে ফেলে টাকা আদায়ের নেশায় কতিপয় মডেল-নায়িকা এই চক্রে জড়িয়ে পড়েছে। গুলশান ১ নম্বর এলাকায় অভিনেত্রী শিলা হাসানের একটি ফ্ল্যাট পার্টি হাউস হিসেবে ব্যাহƒত হচ্ছে। প্রায় সাড়ে ৪ হাজার বর্গফুটের এই ফ্ল্যাটে অনেক দিন ধরে রাতে হয় পার্টির আয়োজন। একেক রাতে ১০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত একেকজন খরচ করেন। ঘণ্টা হিসাবে পার্টি হাউসে ছোট ছোট কক্ষও ভাড়া দেওয়া হয়। বিতর্কিত মডেল মরিয়ম আক্তার মৌর গুলশানে দুটি আলাদা পার্টি হাউস আছে। একজন ফ্যাশন হাউসের কর্ণধার গুলশানে একটি পার্টি হাউস চালান বলে তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা। গ্রেফতারকৃত রাজ তার কার্যালয় ও আলাদা ফ্ল্যাটে পার্টির নামে মাদকের আখড়া বসাতেন। মিশু হাসানেরও ছিল নিয়ন্ত্রিত পার্টি হাউস। পরীমণির সঙ্গী তুহিন সিদ্দিকী অমি বনানী ও উত্তরায় পার্টি হাউসের নিয়ন্ত্রক। হাউস পার্টির আয়োজকরা বিদেশে ‘প্লেজার ট্রিপের’ নামে অনেক ব্যক্তির সঙ্গে চুক্তি করে টাকা আদায় করে।
পরীমণি ও একার সদস্যপদ স্থগিত : চিত্রনায়িকা পরীমণি ও একার সদস্যপদ সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে চলচ্চিত্র শিল্পীদের সংগঠন শিল্পী সমিতি। এই দুই নায়িকার বিতর্কিত কর্মকান্ডের জেরে শনিবার দুপুরে সমিতির সদস্যদের ডেকে কেবিনেট মিটিংয়ে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরে সংবাদ সম্মেলন ডেকে বিকালে বিষয়টি জানান সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগর। পরীমণি ও একার ঘটনায় চলচ্চিত্র শিল্পীদের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে দাবি করে তাদের সদস্যপদ সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে শিল্পী সমিতি। এফডিসির জহির রায়হান কালার ল্যাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মিশা জানান, একা ও পরীমণির ঘটনাটি চলচ্চিত্র তথা শিল্পী সমাজের জন্য বিব্রতকর। কোনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয় না শিল্পী সমিতি। তাদের মামলা চলমান থাকায় একা ও পরীমণির সদস্যপদ সাময়িকভাবে স্থগিত করা হলো।