নিজস্ব প্রতিবেদক
টাঙ্গাইলের মহাসড়কে চলন্ত বাসে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনায় মূল পরিকল্পনাকারী রতনসহ ডাকাত চক্রের ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। এ ঘটনায় ১৩ ডাকাত অংশ নেয়। বাকি তিনজনকে এখনো গ্রেপ্তার করা যায়নি।
গতকাল রোববার গভীর রাত পর্যন্ত ঢাকা, গাজীপুর ও সিরাজগঞ্জে অভিযান চালিয়ে ডাকাত চক্রের মূল পরিকল্পনাকারী মো. রতন হোসেন, মো. আলাউদ্দিন, মো. সোহাগ মন্ডল, খন্দকার মো. হাসমত আলী ওরফে দীপু, মো. বাবু হোসেনওরফে জুলহাস, মো. জীবন, মো. আব্দুল মান্নান, মো. নাঈম সরকার, রাসেল তালুকদার, মো. আসলাম তালুকদার ওরফে রায়হানকে গ্রেপ্তার করা হয়।
আজ সোমবার সকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল-মঈন সংবাদ সম্মেলন করে এ তথ্য জানান।
খন্দকার আল-মঈন জানান, ডাকাতির তিনদিন আগে রতন মিয়া তার সহযোগী ডাকাত রাজা মিয়াকে বাস ডাকাতির প্রস্তাব দিলে সে দলের অন্য ডাকাতদের সংঘটিত করার কথা বলেন। পরবর্তী সময়ে রতন, মান্নান, জীবন, দীপু, আউয়াল ও নুরনবীকে ডাকাতির পরিকল্পনার কথা জানায়। এরপর ডাকাত মান্নান তার সহযোগী সোহাগ, আসলাম, রাসেল, নাঈম ও আলাউদ্দিনকে নিয়ে ডাকাতিতে যোগ দেন। সেদিন ডাকাতিতে রতনের নেতৃত্বে মোট ১৩ জন ডাকাত অংশ নেন।
তিনি জানান, পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী রতনের নেতৃত্বে গত মঙ্গলবার দুপুরে গাজীপুরের জিরানী বাজার এলাকায় সিরাজগঞ্জ থেকে ঢাকাগামী বাসে ডাকাতির পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে। মূল পরিকল্পনাকারী রতন ডাকাতির কাজে প্রস্তুতির আর্থিক খরচ বহন করেন। চক্রের সদস্যদের ছোট ছোট দলে বিভক্ত করে প্রত্যেকের কাজ বুঝিয়ে দেওয়া হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী, রতন ডাকাত ২ আগস্ট রাতে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা মোড়ের একটি দোকান থেকে ডাকাতি কাজে ব্যবহৃত চারটি চাকু, দুটি ধারালো কাঁচি ও একটি ক্ষুর সংগ্রহ করেন।
ওইদিন রাতে ডাকাতদের পুরো দল সিরাজগঞ্জ রোড মোড় এলাকায় ঘোরাঘুরি করতে থাকেন। রাত আনুমানিক ১টার দিকে কুষ্টিয়া থেকে নারায়ণগঞ্জগামী ঈগল এক্সপ্রেস পরিবহনের একটি বাস সিরাজগঞ্জ রোড মোড় এলাকায় পৌঁছালে ডাকাত রাজা বাসটিকে থামার সংকেত দেন এবং যাত্রীবেশে প্রথমে রতন, রাজা, মান্নান ও নুরনবী ঈগল এক্সপ্রেস পরিবহন বাসটিতে উঠেন।
পরবর্তী সময়ে আরও দুই দফায় ডাকাতচক্রের অন্য সদস্যরা বাসটিতে যাত্রীবেশে ওঠেন। বাসটিতে ২৪ জন সাধারণ যাত্রী থাকায় ডাকাত চক্রের অধিকাংশ সদস্য বাসের পেছনের দিকে বসেন। বাসটি যখন বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু এলাকা অতিক্রম করে তখন রতন ডাকাত দলের সদস্যদের চাকু ও ধারালো কাঁচি দেন। আউয়াল ধূমপানের কথা বলে বাসের গেটের কাছে যান এবং অন্যদের ইশারা দিলে রাজা, রতন, মান্নান ও নূরনবী ড্রাইভিং সিটের কাছে গিয়ে ড্রাইভারকে মারধর করে এবং রতন বাসের ড্রাইভিং সিটে বসে বাসের নিয়ন্ত্রণে নেন। ডাকাত দলের বাকি সদস্যরা বাসের চালক ও সুপারভাইজার, হেলপারসহ অন্য সাধারণ যাত্রীদের হাত-মুখ বেঁধে সিট কভার দিয়ে মুখ ঢেকে দেন এবং যাত্রীদের সঙ্গে থাকা নগদ অর্থ, স্বর্ণালংকার ও অন্য মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে এবং শ্লীলতাহানি ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটায়।
এরপর টাঙ্গাইলের হাঁটুভাঙ্গা মোড় হয়ে মধুপুরে যাওয়ার পথে মধুপুরের রক্তিপড়া এলাকায় রতন গাড়ি চালানোর সময় লুট হয় মালামাল। পরে মালামাল নিয়ে ডাকাত দলের সদস্যদের মধ্যে বাগবিতণ্ডার কারণে রতন পেছনের দিকে তাকালে বাসটি রাস্তার পাশের বৈদ্যুতিক খুঁটির সঙ্গে ধাক্কা লেগে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একপাশে হেলে পড়ে। তখন ডাকাতদলের সবাই লুটকৃত মালামালসহ বাস থেকে নেমে পালিয়ে যান। পরবর্তীকালে বাসে করে ডাকাত চক্রের সদস্যরা টাঙ্গাইলের মধুপুর এলাকায় যায় এবং অটোরিকশায় মধুপুরের কুড়ালিয়া এলাকায় রতনের নিকটাত্মীয়ের ফাঁকা বাড়িতে গিয়ে লুট করা মালামাল নিজেদের মধ্যে বন্টন করে। পরে রতন গাজীপুরের বোর্ড বাজার এলাকায় আত্মগোপন করেন।
গ্রেপ্তার মান্নান, আলাউদ্দিন ও বাবু পৃথকভাবে আশুলিয়ার জিরানী বাজার এলাকায় আত্মগোপন করেন। ডাকাত আসলাম, নাঈম, রাসেল প্রথমে নিজের এলাকায় ও পরবর্তীকালে সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ এলাকায় আত্মগোপন করেন। ডাকাত জীবন কোনাবাড়ীতে আত্মগোপন করেন। ডাকাত দীপু প্রথমে টাঙ্গাইলের পিরোজপুর গ্রামে ও পরবর্তী সময়ে গাজীপুরের কালিয়াকৈর এলাকায় আত্মগোপন করেন। সোহাগ প্রথমে জিরানী বাজার ও পরবর্তীকালে জামালপুর জেলায় এবং পুনরায় জিরানী বাজারে আত্মগোপন করেন।
র্যাব জানায়, রতন হোসেন ডাকাতির মূল পরিকল্পনাকারী। তিনি পেশায় গাড়ির হেলপার। তার নামে আগে থেকেই ডাকাতির অভিযোগ ছিল। রতন ২০১৮ সালে নূরনবী, জীবন ও অন্য কয়েকজনকে নিয়ে রোড ব্লক করে সাভার পরিবহনের একটি বাস ডাকাতি করে। বাস ডাকাতির ঘটনায় রতন গ্রেপ্তার হয়ে প্রায় দেড় বছর কারাভোগের পর জামিনে বের হন ২০২০ সালে। আবারও নূরনবী, জীবন ও আউয়ালকে নিয়ে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে একটি অটোরিকশা ছিনতাই করেন। তখন ঘটনাস্থলে উপস্থিত জনতা জীবনকে ধাওয়া করে ধরে ফেলে। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে রতন প্রায় ১ বছর কারাভোগ করেন। কারাভোগের পর জামিনে বের হয়ে তিনি তার সিন্ডিকেট নিয়ে সাভার, গাজীপুর বা সিরাজগঞ্জ এলাকায় মহাসড়কে আরও বেশ কয়েকটি ডাকাতি করেন।
সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, জীবন পেশায় গাড়ির হেলপার। টাঙ্গাইলে ডাকাতিতে তিনি যাত্রীদের মালামাল লুটের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি ২০১৮ ও ২০২০ সালে দুটি ডাকাতির মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করেন। মান্নান গাজীপুরের একটি গার্মেন্টে চাকরি করতেন। তিনি ২০১৯ সালে আশুলিয়া থানায় একটি চুরির মামলায় কারাভোগ করেছেন বলে জানা গেছে। তার নেতৃত্বে ঢাকা ও গাজীপুরের বিভিন্ন গার্মেন্টসে চাকরিরত আলাউদ্দিন, সোহাগ, বাবু, দীপু, রাসেল, রায়হান, নাঈম ডাকাতিতে অংশ নেন।
উল্লেখ্য, ২ আগস্ট রাতে কুষ্টিয়া থেকে নারায়ণগঞ্জগামী ঈগল এক্সপ্রেস পরিবহনের একটি বাস টাঙ্গাইল অতিক্রম করার সময় ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় এক যাত্রী বাদী হয়ে মধুপুর থানায় অজ্ঞাত ১০-১২ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন।