আপিল শুনানিতেও বিএনপি চেয়ারপারসন কারাবন্দি খালেদা জিয়ার প্রার্থিতা বাতিল হয়েছে। তিন আসনে তার মনোনয়নপত্র বাতিলের বিরুদ্ধে আলাদা তিনটি আপিল সংখ্যাগরিষ্ঠতার (৪-১ ভোট) ভিত্তিতে নামঞ্জুর করেছে নির্বাচন কমিশন।
মামলায় সাজার কারণে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও তিন নির্বাচন কমিশনার তার আপিল নামঞ্জুর করে রায় দেন। অপর দিকে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার আবেদনটি মঞ্জুর করে রায় দেন। এ অবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে বিএনপি চেয়ারপারসনের আপিল নামঞ্জুর হয়ে যায়।
এটাই বর্তমান কমিশনের প্রথম বিভক্তি রায়। এ রায় নিয়ে কমিশনে ব্যাপক হইচই করেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির আইনজীবীরা। এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করার কথা জানিয়েছেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা।
এর আগে ২ ডিসেম্বর যাচাই-বাছাইয়ে ফেনী-১, বগুড়া-৬ ও ৭ আসনে তার মনোনয়নপত্র বাতিল করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। তৃতীয় দিন শনিবার শুনানিতে ৮৫ জন প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন।
সব মিলে তিন দিনে ২৪৩ জন প্রার্থিতা ফিরে পেলেন। যদিও আপিল করেছিলেন ৫৪৩ জন। শুনানি শেষে সব মিলিয়ে এ নিবাচনে বৈধ প্রাথীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল দুই হাজার ৫২২ জনে। আজ রোববার প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন নির্ধারিত রয়েছে। এর পরই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চূড়ান্ত প্রার্থীর সংখ্যা জানা যাবে।
শুনানির শেষ দিনে শনিবার বিএনপি নেতা মোরশেদ খান, ঢাকা-৯ আসনে আফরোজা আব্বাস প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন। এ সময় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসসহ বেশ কয়েকজন প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিলের জন্য আপিল হলেও তা নামঞ্জুর হয়। এর ফলে তাদের প্রার্থিতা টিকে গেছে।
গত তিন দিনে অন্তত ২০ জন প্রার্থীর বৈধতা নিয়ে শুনানি হলেও কারও প্রার্থিতা বাতিল করেনি ইসি। প্রথম দিন ৮০ জন এবং দ্বিতীয় দিন সব মিলে ৭৮ জনের প্রার্থিতা ফিরে আসে। সবশেষ শনিবার ফিরে পেয়েছেন ৮৫ জন।
গত তিন দিনে সবচেয়ে বেশি প্রার্থিতা ফিরেছে বিএনপির। এ তিন দিনে বিএনপির ৭৮ জন প্রার্থী আপিলে ফিরেছেন। অপর দিকে আওয়ামী লীগের প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন দু’জন। স্বতন্ত্র প্রার্থী ৪৪ জন, বাকিরা অন্য রাজনৈতিক দলের।
এ নির্বাচনে ৩৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে তিন হাজার ৬৫ প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করেন। এর মধ্যে ৩৯টি রাজনৈতিক দলের প্রার্থী সংখ্যা দুই হাজার ৫৬৭ ও বাকি ৪৯৮ জন স্বতন্ত্র।
২ ডিসেম্বর রিটার্নিং কর্মকর্তারা যাচাই-বাছাই করে ৭৮৬ জনের মনোনয়নপত্র বাতিল করেন। এর মধ্যে বিএনপির ১৪১ ও আওয়ামী লীগের তিনজন রয়েছেন। পরে কমিশনে আপিল করেন ৫৪৩ জন।
আপিলকারীদের মধ্যে অন্তত ২০ প্রার্থীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আপিল জমা হয়। বাকি সবাই প্রার্থিতা ফিরে পেতে আবেদন করেন। সিইসি কেএম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের কমিশন এসব আপিল আবেদন নিষ্পত্তি করেন।
বিভক্তি রায়ে খালেদা জিয়ার আপিল নামঞ্জুর :
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার তিনটি আসনের আলাদা তিনটি আপিল আবেদন সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে নামঞ্জুর করেছেন নির্বাচন কমিশন।
শনিবার সন্ধ্যায় নির্বাচন ভবনে খালেদা জিয়ার আবেদনের শুনানি শেষে ইসি এ সিদ্ধান্তের কথা জানায়। তবে খালেদা জিয়ার প্রার্থিতা ফিরিয়ে দেয়ার পক্ষে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার মত দেন।
অপর দিকে দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ায় সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রার্থিতা বাতিলের পক্ষে রায় দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ (সিইসি) অপর চার কমিশনার।
শনিবার দুপুরের আগেই খালেদা জিয়ার তিনটি আপিল একই সঙ্গে শুনানি হয়। পরে কমিশন বিকাল ৫টায় ফের শুনানি হবে বলে মুলতবি করেন। এরপর সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে পুনরায় খালেদা জিয়ার আপিল শুনানি শুরু হয়।
এ সময় বিএনপি চেয়ারপারসনের পক্ষে আইনজীবী এজে মোহাম্মদ আলী, জয়নাল আবেদীন ও মাহবুব উদ্দিন খোকন যুক্তি-তর্কে অংশ নেন। শুনানিতে আইনজীবীরা বলেন, রিটার্নিং কর্মকর্তা ১২/১(ঘ) অনুসারে মনোনয়নপত্র বাতিল করেছেন।
এ ধারা নির্বাচনী অপরাধের সঙ্গে সম্পর্কিত, মনোনয়নপত্র বাতিলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। কিন্তু বিএনপি চেয়ারপারসনের সাজা হয়েছে দুর্নীতি মামলায়, নির্বাচনী অপরাধে নয়।
নির্বাচন কমিশনে বিএনপির চেয়ারপারসনের মনোনয়নপত্রের বৈধতা নিয়ে আপিল শুনানি চলাকালে আইনজীবীরা কমিশনের কাছে জানতে চান, খালেদা জিয়া কারাগারে, তিনি কীভাবে আচরণবিধি লঙ্ঘন করলেন বা নির্বাচনী অপরাধ করলেন? আর এই কারণে কীভাবে খালেদা জিয়ার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়? তারা আইনের ধারা উল্লেখ করে খালেদা জিয়ার পক্ষে রায় দাবি করেন।
শুনানিতে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা আরও বলেন, খালেদা জিয়ার মনোনয়নপত্র বাতিলের কারণ হিসেবে রিটার্নিং কর্মকর্তা যা দেখিয়েছেন, সে অনুসারে তার মনোনয়নপত্র বাতিল সঠিক হয়নি।
সে কারণে কমিশনের কাছে আপিল করা হয়েছে। তারা বলেন, প্রতিটি নাগরিকের অধিকার রয়েছে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার। সেই ক্ষেত্রে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে খালেদা জিয়াকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার কোনো সুযোগ নেই।
তার পরও আইনগতভাবে খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার অধিকার রাখেন। যে আদেশ রিটার্নিং কর্মকর্তারা দিয়েছেন, আইনের দৃষ্টিতে তা বৈধ নয়। আমরা মনে করি, নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে যথাযথ আদেশ দেবে।
রিটার্নিং কর্মকর্তারা যে আদেশ দিয়েছেন, কমিশন তা বাতিল করবে। আমরা আশা করি, আগামী নির্বাচনে খালেদা জিয়া অংশ নেবেন। তাদের মতে, রিটার্নিং কর্মকর্তা যে আদেশ দিয়েছেন এখন তার ওপরই কমিশন আদেশ দিতে পারবে। এর বাইরে যাওয়ার আইনগত কোনো সুযোগ নেই।
পরে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের বিপক্ষে মতামত উপস্থাপন করেন। এ সময় কোনো পক্ষের আইনজীবী না হওয়ার পরও ইউসুফ হোসেনের বক্তব্যের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এজে মোহাম্মদ আলী।
এতে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা আদালতে উচ্চৈঃস্বরে কথাও বলেন। তাকে উদ্দেশ্য করে এজে মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘হু আর ইউ’। পরে ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন তার বক্তব্য তুলে ধরেন। এ সময় আওয়ামীপন্থী অনেক আইনজীবী সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
শুনানি শেষ পর্যায়ে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার তার রায় পড়ে বলেন, রিটার্নিং অফিসার কর্তৃক যথাক্রমে ফেনী-১, বগুড়া-৭ ও ৮-এ খালেদা জিয়ার মনোনয়নপত্র বাতিলের বিরুদ্ধে যে আপিল দায়ের করা হয়েছে, তা আইনগত বিশ্লেষণ করে রায় এই আপিল মঞ্জুরের পক্ষে। আমি এই আপিল মঞ্জুর করলাম।
মাহবুব তালুকদারের পরপরই বিএনপির আইনজীবীরা উল্লাস করে কমিশনের কোর্ট রুমের পেছনের দিকে চলে যেতে উদ্ধত হন। তারা বলতে থাকেন, কমিশনের রায় পেয়ে গেছি।
অপর দিকে আওয়ামী আইনজীবীরা এর বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে শুরু করেন। এ সময় নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, আপনারা ঠাণ্ডা হয়ে বসেন। এ রায় পূর্ণাঙ্গ নয়, এটি মাত্র একজনের রায়।
উত্তপ্ত আদালত কক্ষেই কমিশনার রফিকুল ইসলাম তার রায় ঘোষণা শুরু করেন। তিনি বলেন, সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দণ্ডপ্রাপ্তরা নির্বাচন করতে পারেন না। এ কারণে খালেদা জিয়ার আপিল নামঞ্জুর করা হল।
এরপর কমিশনার শাহাদাত হোসেন চৌধুরীও একই রায় প্রদান করেন। কমিশনার কবিতা খানমও এ দুই কমিশনারের পক্ষে মত দিয়ে বলেন, খালেদা জিয়া দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে আছেন।
সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে নৈতিক স্খলনজনিত কারণে দণ্ডিত হয়ে তিনি (খালেদা জিয়া) এখন কারাগারে। তার দণ্ড স্থগিত হয়নি। মনোনয়নপত্র বাতিল করে সংশিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তারা যে আদেশ দিয়েছেন, তার স্পিরিট বিবেচনা করে সেই অনুযায়ী আপিল নামঞ্জুর করা হল।
এরপর প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা বলেন, আমি আমার কমিশনার রফিকুল ইসলাম, শাহাদাত হোসেন ও কবিতা খানম- এ তিনজনের পক্ষে রায় দিলাম। এই আপিল আবেদন মঞ্জুর হয়নি।
পরে সচিব বলেন, ৪-১ ভোটে এই আপিল নামঞ্জুর হল। শনিবার আপিলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিএনপি ১৮, গণফোরাম চার, খেলাফত মজলিস এক, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি তিন, বিকল্পধারা পাঁচ, জাতীয় পার্টি-জেপি দুই, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফ চার, ইসলামী ফ্রন্ট এক, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এক, ইসলামী ঐক্যজোট এক, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সাত, ন্যাশনাল পিপলস পাটি-এনপিপি দুই, জাকের পার্টি ছয়, মুসলিম লীগ পাঁচ, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি-জাগপা এক, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ দুই, খেলাফত আন্দোলন এক ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের তিনজন প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন। এদিন স্বতন্ত্র ১৮ জন প্রার্থীর আপিল মঞ্জুর হয়েছে।
শনিবার আপিলে ফিরলেন যারা :
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, শনিবার যাদের মনোনয়নপত্র বৈধ হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন- বিএনপির চাঁদপুর-৪ আসনে জেড খান মো. রিয়াজউদ্দিন, বান্দরবান পার্বত্য জেলা মা ম চিং, চট্টগ্রাম-৮ এম মোরশেদ খান, রাজশাহী-৫ মো. আবুবকর সিদ্দিক, রাজশাহী-৬ মো. আবু সাঈদ চাঁদ, টাঙ্গাইল-১ ফকীর মাহবুব আনাম স্বপন, ঢাকা-১৭ শওকত আজিজ, ঢাকা-১৯ মো. কাফিল উদ্দিন, নীলফামারী-১ আসনের এ আহম্মেদ বাকের বিল্লাহ (মুন) ও রাজশাহী-৫ মো. নাদিম মোস্তফা। এদিন বিএনপির যেসব প্রার্থী আবেদন করেও প্রার্থিতা ফিরে পাননি তাদের মধ্যে রয়েছেন- চট্টগ্রাম-৫ মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, ঝিনাইদহ-২ মো. মশিউর রহমান ও চাঁদপুর-৪ আসনের বিএনপির হারুন অর রশীদ।
এর আগে বৃহস্পতি ও শুক্রবার এ দুই দিনে মোট ১৫৮ জন প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন। এর মধ্যে বিএনপির ৬০ জন, আওয়ামী লীগের দু’জন, গণফোরামের দু’জন, এলডিপি তিনজন, জাকের পার্টি ১২ জন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ আটজন, জাসদ চারজন, জেএসডি দু’জন, সিপিবি পাঁচ জন, ইসলামী ঐক্যজোট চারজন, এনপিপি চারজন, বিএনএফ দু’জন, খেলাফত মজলিস দু’জন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস একজন, বাংলাদেশ ইসলামিক ফ্রন্ট তিনজন, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ একজন ও মুসলিম লীগের দু’জন প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন। স্বতন্ত্র ও অন্য দলের প্রার্থীদেরও মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা দেয়া হয়েছে।