প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের স্কুলে উপস্থিতি তদারকিরর জন্য বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। কিন্তু ২০১৯ সালের শতকোটি টাকার প্রকল্পটি আর বাস্তবায়িত হয়নি। বরং ইতোমধ্যে খরচ হয়েছে সাড়ে ৬৩ কোটি টাকা। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের বর্তমান কর্তারা বলছেন, বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে হাজিরা নেয়ার প্রকল্প হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে করা হয়েছে। এর জন্য কোনো পূর্বপরিকল্পনা ছিল না।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই) সূত্রে জানা যায়, চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় শিক্ষক-কর্মচারীদের বায়োমেট্রিক হাজিরা নিশ্চিতকরণের জন্য ডিভাইস ক্রয়ের বিধান রাখা হয়েছে। ২৮ মার্চ, ২০১৯ তারিখে অনুষ্ঠিত প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রকল্পসমূহের অগ্রগতি পর্যালোচনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ পর্যন্ত পর্যালোচনা সভার কার্যবিরণীতে বিদ্যালয়ে বায়োমেট্রিক হাজিরা নিশ্চিতকরণের জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়। তাড়াহুড়ো করে কোনো ধরনের পরিকল্পনা ছাড়াই তাৎক্ষণিক স্লিপ (স্কুল লেভেল ইমপ্রুভমেন্ট ফান্ড) ফান্ডের টাকা থেকে শিক্ষকদের ডিজিটাল হাজিরা মেশিন ক্রয়ের কথা বলা হয়। ওই বছরই মেশিন ক্রয়ের জন্য আরও দুই দফা নির্দেশনা দেয় ডিপিই। এরপর ২০১৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর মেশিন না কেনার জন্য নিষেধ করা হয় এবং ইতোমধ্যে যারা যন্ত্রটি ক্রয় করেনি, তাদের টাকা ফেরত পাঠাতে বলা হয়। পরের বছর জানুয়ারিতে বায়োমেট্রিক্স মেশিন ইনস্টল করে ব্যবহারের জন্য অধিদপ্তর থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়।
জানা যায়, ২০১৯ সালের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ৬৫ হাজার ৬২০টি। সর্বমোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১০০ কোটি টাকারও বেশি। ওই নির্দেশনায় দেশে ৬৫ হাজার ৬২০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৩২ হাজার ৫২৫টি বিদ্যালয় বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন স্থাপন করা হয়। এতে ব্যয় হয় ৬৩ কোটি ৩৩ লাখ ৫২ হাজার ৩৬৬ টাকা। বাকি টাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ফেরত নেয়া হয়। ১৫ ডিসেম্বও ২০২১-এর ডিপিই তথ্য অনুযায়ী সচল রয়েছে ২৭৯৩৩টি বায়োমেট্রিক মেশিন। অচল হয়েছে ৪৫৮২টি।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, করোনার কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোতে যন্ত্রটি ব্যবহারের প্রয়োজন পড়েনি। ফলে দীর্ঘদিন অবহেলায় থাকায় অধিকাংশ যন্ত্রই নষ্ট হয়ে গেছে। রাজবাড়ী জেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঁচজন প্রধান শিক্ষক বলেন, এটা শুধুমাত্র ক্রয় করা হয়েছিল কিন্তু এর পূর্ণাঙ্গ সেটআপই হয়নি। পুরো টাকাই জলে গেছে। অধিকাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গটি তো শিক্ষকরা ভুলেই গেছেন।
ঝালকাঠি জেলা সদর উপজেলার বৈদারাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ওবায়দুল বলেন, বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন ক্রয় করা হয়েছিল; তবে এখন পর্যন্ত এটা চালু হয়নি। সচল আছে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন ঠিক জানি না কী অবস্থায় আছে, তবে চালু করা হয়নি।
কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার বাউফল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শিক্ষক ফাইয়াজ উল্লাহ বলেন, বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন সচল আছে; কিন্তু এটা যে উদ্দেশ্যে স্থাপন হয়েছিল— তার অফিসিয়ালি কোনো কার্যক্রম নেই।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখার উপপরিচালক ড. মো. নুরুল আমিন চৌধুরী বলেন, শিক্ষকদের বায়োমেট্রিক্স প্রকল্পের বিষয়টি আমরা চিন্তা-ভাবনা করছি। এটি আগামীতে একটি প্রকল্পের আওতায় আসবে। তবে না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলতে পারছি না। আগের প্রকল্প হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে করা হয়েছে। এর জন্য আলাদা কোনো পরিকল্পনা ছিল না। পূর্বের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নতুন করে আরেকটি করার চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে।
জনগণের সম্পদ অপচয়কারীদের জবাবদিহির আওতায় আনার কথা জানিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখার আহমেদ বলেন, সাড়ে ৬৩ কোটি টাকার সম্পদের অপচয় হয়েছে। জনগণের সম্পদের অপচয় কাম্য নয়। প্রশাসনের দায়িত্বরতদের নিজেদের কাজের ব্যাপারে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়া উচিত। আগামীতে আবার এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণের আগে এ প্রকল্পের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় পুনরায় এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করা নৈতিক হবে না।