বলিউড শাহেনশাহ হয়ে ওঠার পথটা খুব মসৃণ ছিল না অমিতাভ বচ্চনের জন্য। কর্মজীবনের শুরুতে সামান্য বেতনের একজন কর্মচারী ছিলেন তিনি। এরপর কীভাবে শক্তিমান অভিনেতা হয়ে ওঠলেন তিনি? বিবিসি বাংলার তথ্য অনুসারে সে কথাই তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ
শিপিং কোম্পানির কর্মচারী
প্রথম জীবনে অমিতাভ বচ্চনকে যেতে হয়েছিল বেশ কষ্টকর সময়ের মধ্য দিয়ে। এমন একটা সময় ছিল যখন তাঁর কোনো থাকার জায়গা ছিল না। নিঃস্ব অবস্থায় দিনের পর দিন মেরিন ড্রাইভের বেঞ্চেই তখন রাত কাটাতেন এলাহাবাদ থেকে আগত এই তারকা। বলিউডে প্রবেশ করার আগে অমিতাভ বচ্চন বেশ কিছুদিন কলকাতার একটি শিপিং সংস্থার কর্মচারী ছিলেন। শিপিং সংস্থায় কাজ করার সময় পণ্যের দালালি করতেন অমিতাভ। বিএ পাস করার পর অমিতাভ বচ্চন কলকাতায় বার্ডস অ্যান্ড কোম্পানিতে চাকরি নেন। সেটা ছিল ষাটের দশকের শেষ দিকের কথা।
বার্ডস কোম্পানির কয়লা খনি, চটকল, কাগজ কলসহ বিভিন্ন ব্যবসা ছিল। কলকাতার ডালহৌসি এলাকায় মহাকরণের কাছেই ছিল ওই কোম্পানির সদর দফতর। ১৯৭৪ সালে ওই কোম্পানি সরকার অধিগ্রহণ করে নেয়। তাদের হাতে রয়ে যায় শুধু চটকলের ব্যবসা। ২০১১ সালে অমিতাভ বচ্চন টুইট করেছিলেন পুরনো সেই দিনের কথা মনে করে। তাতে তিনি লিখেন- ‘কলকাতা… তখনকার ক্যালকাটা… প্রথম চাকরি বার্ড অ্যান্ড কোং-এ… বেতন ৫০০ টাকা। প্রতি মাসে কেটেকুটে ৪৬০ টাকা’।
এগিয়ে এলেন মা
১৯৬৮ সালে প্রখ্যাত ফিল্ম পরিচালক শ্রাভন কুমারকে অমিতাভ বচ্চনের মা তেজি বচ্চন বলেছিলেন, তাঁর ছেলে ফিল্মে কাজ করতে আগ্রহী। মি. টাক সেই সময়ে মির্জা গালিবের ওপরে একটা ছবি করার পরিকল্পনা করছিলেন। তিনি অমিতাভ বচ্চনকে মির্জা গালিবের চরিত্রটা দেওয়ার কথা ভেবে ফেলেছিলেন। কিন্তু তাঁর ঘনিষ্ঠরা তাঁকে বোঝান যে, গালিবের চরিত্রে অমিতাভ বচ্চন মানানসই হবেন না, কারণ তিনি ভীষণ লম্বা, আর গালিব বেশ বেঁটেই ছিলেন। এরপর অভিনেতা সুনীল দত্তের সুপারিশে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা বি আর চোপরা অমিতাভ বচ্চনের স্ক্রিন টেস্ট নিতে রাজি হলেন। কিন্তু তারপর চোপরার কাছ থেকে আর কোনো সাড়া পাননি তিনি।
সব জায়গা থেকেই বাদ
অমিতাভ বচ্চন যেখানেই অভিনয়ের জন্য গেছেন সব জায়গা থেকেই বাদ হয়ে যাচ্ছিলেন। আকাশবাণী তাঁকে পছন্দ করেনি আগে। তারপর তিনি মুম্বাই গেলেন। সুনীল দত্ত তখন বি আর চোপড়ার ছবিতে নিয়মিত কাজ করতেন। সুনীল দত্ত সুপারিশ করেছিলেন অমিতাভ বচ্চনের জন্য। তিনি গিয়েছিলেন চোপড়ার সঙ্গে দেখা করতে। চোপরা অমিতাভকে দেখার পর বিশেষ কোনো আগ্রহ দেখাননি অমিতাভের ব্যাপারে। তবে একটা কাজ তিনি করেছিলেন। এরপর ফিল্ম প্রোডিউসার তারাচাঁদ বরজাতিয়া অমিতাভ বচ্চনকে দেখেই বাতিল করে দিলেন। বললেন, আরে আপনাকে তো দেখতে কবি কবি মনে হয়। অমিতাভ কুর্তা-পাজামা পরতেন। বরজাতিয়া তাই তাঁকে বললেন, ‘কবিতা লিখুন বাবার মতো’। এরকম আরও অনেকেই বাতিল করেছেন অমিতাভ বচ্চনকে।
প্রথম সিনেমায় ৫ হাজার টাকা
অমিতাভকে প্রথম ফিল্মে নেন নামকরা পরিচালক খাজা আহমেদ আব্বাস। পরিচালক টিনু আনন্দের বন্ধু নীনা সিং অমিতাভ বচ্চনের কিছু ছবি আব্বাসকে দেখান। আব্বাস বললেন, ৫ হাজার টাকা দিতে পারব। কিন্তু এটা বলতে পারব না যে, ছবিটা তৈরি হতে ৫ মাস লাগবে না এক বছর।
যেভাবে সিনেমায় সুযোগ হলো
আব্বাস সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন তোমার নাম কি? তিনি জবাব দিয়েছিলেন তাঁর নাম অমিতাভ বচ্চন। সেটা শুনেই আব্বাস বলেছিলেন তুমি আমার বন্ধু হরিভনশ রাই বচ্চনের ছেলে না কি? তাঁর জবাব ছিল, হ্যাঁ। তিনি তখন জানতে চান যে, বাবার মত নিয়ে এসেছ তো? তিনি জানিয়েছিলেন, হ্যাঁ বাবা-মা জানেন আমার এখানে আসার কথা। তিনি মানতে চাননি, বলেছিলেন, আমি তাঁকে চিঠি লিখব। হরিভনশ রাই বচ্চনকে চিঠি লিখলেন আব্বাস সাহেব। লিখলেন আপনি অনুমতি দিলে আপনার ছেলেকে ছবিতে নেব। হরিভনশজি টেলিগ্রাম করে জবাব দিয়েছিলেন আপনার সঙ্গে ফিল্মে কাজ করলে আমার আপত্তি নেই। ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯-এ অমিতাভ তাঁর প্রথম ছবি ‘সাত হিন্দুস্তানি’র জন্য চুক্তি সই করেন। প্রথম ছবির জন্যই অমিতাভ জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন।
আজীবনের প্রতিজ্ঞা
খাজা আহমেদ আব্বাস ছবি করার সময় খুুশি হলে তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে কোনো একজনকে ৫০ টাকা দিয়ে বলতেন যাও মজা কর। একবার অমিতাভ বচ্চনও ৫০ টাকা পেয়েছিলেন। টাকা পেয়েই তিন বন্ধু- অমিতাভ বচ্চন, জালাল আগা আর আনোয়ার আলি একটা স্মরণীয় সন্ধ্যা কাটানোর প্ল্যান করলেন। তিনজনে জমিয়ে মদ্যপান করলেন। পরের দিন আনোয়ার আলি বচ্চনকে পরামর্শ দিলেন ‘যতদিন ইন্ডাস্ট্রিতে তোমার নাম না হচ্ছে, ততদিন মদ ছোঁবে না’। সেদিনই অমিতাভ বচ্চন মদ খাওয়া ছেড়ে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন। সারা জীবন তিনি এই প্রতিজ্ঞা পালন করে এসেছেন। তবে একবার মাত্র তিনি সামান্য মদ্যপান করেছিলেন, ছোট ভাই অজিতাভের বিয়ের দিনে।
উত্তম কুমারের পরিবর্তে
প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋষিকেশ মুখার্জি ‘আনন্দ’ ছবির জন্য একজন অভিনেতা খুঁজছিলেন। অমিতাভ বচ্চনকে দেখেই তিনি বুঝলেন যে, তিনি তাঁর ‘বাবুমশায়’ খুঁজে পেয়েছেন। এর আগে ওই চরিত্রের জন্য তিনি উত্তম কুমারকে নেওয়ার কথা ভাবছিলেন। ঋষিকেশ মুখার্জি বলেন, ‘অমিতাভের গম্ভীর গলার আওয়াজ আর তাঁর চাহনির জন্য তাঁকে বেছেছিলাম। আমার বলতে দ্বিধা নেই, ওই ছবিতে রাজেশ খান্নার থেকেও ভালো অভিনয় করেছিল অমিতাভ।’
প্রথমবার যেভাবে সফল
ফ্লপ ছবির সঙ্গে লড়তে লড়তে একসময় অমিতাভ আলোর মুখ দেখলেন। তাঁর অভিনীত প্রথম সুপারহিট ছবি ‘জঞ্জির’। ১৯৭৩ সালে মুক্তি পায় ছবিটি। প্রকাশ মেহেরা ছিলেন এই ছবির নির্মাতা। ছবির কাহিনিকার ছিলেন জাভেদ আখতার। ১৯৭৩ সালে রিলিজ হওয়া ‘জঞ্জির’ সুপারহিট হয়ে গেল। ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কারে ৯টা আলাদা ক্যাটাগরিতে নমিনেশন পেল ছবিটা। এই ছবিটাই একজন ফ্লপ অভিনেতাকে সুপারস্টার বানিয়ে দিল। এখান থেকেই তাঁর ‘অ্যাংরি ইয়াং ম্যান’ ভাবমূর্তির শুরু। সারা দেশে শুরু হলো তাঁকে নিয়ে উন্মাদনা। তবে অমিতাভ বচ্চন নিজে মনে করেন তাঁর ‘অ্যাংরি ইয়াং ম্যান’ ভাবমূর্তিটা শুরু হয়েছিল ১৯৭৩ সালে রিলিজ হওয়া ঋষিকেশ মুখার্জির ছবি ‘নমকহারাম’ থেকে। ঋষিকেশ মুখার্জি বলতেন ‘আনন্দ’ ছবিটা করার সময়ই তিনি অমিতাভ বচ্চনের শক্তিশালী ‘অন স্ক্রিন প্রেজেন্স’টা টের পেয়েছিলেন। তাঁর কথায়, ‘আমি বুঝতে পারছিলাম গম্ভীর কণ্ঠস্বর আর চোখের চাহনি দিয়েই কোনো চরিত্রকে শক্তিশালী করে তোলার এক আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তাঁর। সে জন্যই ‘নমকহারাম’ ছবিতে তাঁর চরিত্রটাকে আমি ‘অ্যাংরি ইয়াং ম্যান’-এ রূপ দিয়েছিলাম। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত বলিউডের শাহেনশাহ হয়েই রইলেন এই জীবন্ত কিংবদন্তি অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন।