নিজস্ব প্রতিবেদক
ডলার সংকট কাটাতে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ১৬ শতাংশ কমানোর পর চলতি অর্থবছরেও ২০ শতাংশের বেশি আমদানি কমানো হয়েছে। তার পরও বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যের (ব্যালান্স অব পেমেন্ট বা বিওপি) ঘাটতি কমাতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। অক্টোবর শেষে দেশের বিওপি ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৮৩ কোটি ডলার।
দেশে যে পরিমাণ ডলার ঢুকছে, এখনো বেরিয়ে যাচ্ছে তার চেয়ে বেশি। এ কারণে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট বা আর্থিক হিসাবের ঘাটতিও বড় হচ্ছে। অক্টোবর শেষে এ ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৯৬ কোটি ডলার। আর্থিক হিসাবে ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষয় থামানো যাচ্ছে না। বরং দিন দিন রিজার্ভ পরিস্থিতি আরো বেশি নাজুক হয়ে উঠছে। গত ২৯ নভেম্বর আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী দেশের রিজার্ভ ছিল ১ হাজার ৯৪০ কোটি বা ১৯ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার। তবে এর মধ্যে ব্যবহারযোগ্য নিট রিজার্ভ ছিল ১৬ বিলিয়ন ডলারেরও কম।
আমদানি না কমালে দেশের বৈদেশিক লেনদেনের সূচকগুলো আরো খারাপ হতো বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক। তিনি বলেন, ‘আমদানি ব্যয় কমিয়ে আনার ইতিবাচক প্রভাব এরই মধ্যে বিওপিতে দৃশ্যমান হচ্ছে। চলতি হিসাব এখন উদ্বৃত্তের ধারায় ফিরেছে। তবে এখনো ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের ঘাটতি থেকে গেছে। এ হিসাব ইতিবাচক ধারায় ফিরলে দেশের রিজার্ভ ঘুরে দাঁড়াবে। ডলার সংকটও পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’
মেজবাউল হক বলেন, ‘সুদহার অনেক বাড়িয়ে দেয়ায় বিদেশী বিনিয়োগ এখন যুক্তরাষ্ট্রমুখী। আন্তর্জাতিক বাজারে সুদহার না কমলে বাংলাদেশে বিদেশী ঋণপ্রবাহ বাড়ার সম্ভাবনা কম। এ কারণে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের ঘাটতি এখনই কমানো যাচ্ছে না। তবে আশা করছি, জাতীয় নির্বাচনের পর এ পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়ে যাবে। দেশে নতুন বিদেশী ঋণের পাশাপাশি বিনিয়োগও আসবে।’
গতকাল দেশের বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যের সর্বশেষ তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) আমদানি ব্যয় ছিল ২৫ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এ ব্যয় ২০ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলারে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরে আমদানি কমেছে ২০ দশমিক ৫৪ শতাংশ। গত অর্থবছরে দেশের মোট আমদানি ব্যয় ছিল ৬৯ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে রেকর্ড ৮৯ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল। ওই অর্থবছরের আমদানি আমলে নিয়ে চলতি অর্থবছরে দেশের আমদানি ব্যয় প্রায় ৪০ শতাংশ কমে গেছে।
আমদানি নিয়ন্ত্রণ করায় চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৯৬২ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এ ঘাটতির পরিমাণ ৩৮১ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। বাণিজ্য ঘাটতি কমার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স বা চলতি হিসাবের ভারসাম্যে। অক্টোবর শেষে চলতি হিসাবে ২৩ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত ছিল। যদিও গত অর্থবছরের একই সময়ে চলতি হিসাবে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৪৪৯ কোটি ডলার।
চলতি হিসাবের উদ্বৃত্ত কিছুটা স্বস্তি দিলেও উদ্বেগ বাড়াচ্ছে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের বড় ঘাটতি। অক্টোবরে এ ঘাটতি ৩৯৬ কোটি ডলারে ঠেকেছে। তীব্র ডলার সংকট সত্ত্বেও গত অর্থবছরের একই সময়ে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে ১২৭ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত ছিল। দেশের বেসরকারি খাত থেকে স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণের উল্লেখযোগ্য অংশ চলে যাওয়া, নতুন করে বিদেশী ঋণ আসার প্রবণতা কমে যাওয়া, দেশের পুঁজিবাজার থেকে বিদেশী বিনিয়োগ প্রত্যাহার ও বিদেশী দান-অনুদান কমে যাওয়ার কারণেই ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাস শেষে দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্ট বা বিওপির ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৮৩ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ ঘাটতির পরিমাণ ৪৭০ কোটি ডলার পর্যন্ত উঠেছিল।
কোনো দেশে আন্তর্জাতিক সম্পদের মালিকানা বাড়া বা কমার বিষয়টি পরিমাপ করা হয় ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট বা আর্থিক হিসাবের মাধ্যমে। এ হিসাবে ঘাটতি সৃষ্টি হলে দেশের রিজার্ভ ও বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারের ওপর চাপ বাড়ে। চলতি শতকের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বেশির ভাগ সময়ই বাংলাদেশের আর্থিক হিসাব উদ্বৃত্ত ছিল। বিশেষ করে ২০১০ সাল-পরবর্তী এক যুগে কখনই আর্থিক হিসাবে ঘাটতি দেখা যায়নি। কিন্তু ডলার সংকট তীব্র হয়ে ওঠায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে আর্থিক হিসাবে বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হয়। গত অর্থবছর শেষে এ ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ২১৪ কোটি ২০ লাখ ডলারে। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্তের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৫৪৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরেও আর্থিক হিসাবে ১ হাজার ৪০৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত ছিল। ২০১৯-২০ অর্থবছরে আর্থিক হিসাবে ৮৬৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৫১৩ কোটি, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৯০১ কোটি ১০ লাখ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪২৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।
আর্থিক হিসাবের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই), পোর্টফোলিও বিনিয়োগ, অন্যান্য বিনিয়োগ ও রিজার্ভ অ্যাসেট বিবেচনা করা হয়। অন্যান্য বিনিয়োগের মধ্যে রয়েছে বৈদেশিক সহায়তা, সরকারের মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ, ঋণের কিস্তি পরিশোধ, দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদি বাণিজ্যিক ঋণ, ট্রেড ক্রেডিট বা রফতানির বিপরীতে প্রত্যাবাসিত অর্থ এবং অন্যান্য সম্পদ ও দায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে দেশে ডলার প্রবাহের প্রায় সবক’টি খাতই সংকুচিত হয়েছে।
ডলার প্রবাহ কমে যাওয়ায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষয় বেড়েই চলেছে। গত ২৯ নভেম্বর আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী (বিপিএম৬) দেশের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল মাত্র ১৯ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভের পরিমাণ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছিল। সে হিসাবে গত দুই বছরের ব্যবধানে রিজার্ভের পরিমাণ অর্ধেকেরও অনেক নিচে নেমে এসেছে।
দেশের অর্থনীতির সামগ্রিক ভারসাম্য ফিরতে অনেক সময় লাগবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে শুধু আমদানি কমিয়ে অর্থনীতিতে ভারসাম্য ফেরানো সম্ভব হবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের কড়াকড়ির কারণে আমদানি ব্যয় কমে এসেছে। কিন্তু এটি অনন্তকাল ধরে চলতে পারে না। এরই মধ্যে দেশের রফতানি প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক ধারায় চলে গেছে। রেমিট্যান্স প্রবাহও প্রত্যাশা অনুযায়ী বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। ডলারের দর নিয়ে চাপাচাপি ও অস্পষ্টতার কারণে হুন্ডির বাজার অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। বিদেশী বিনিয়োগ ও ঋণপ্রবাহ না বাড়লে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের ঘাটতি আরো বড় হবে।’