জয়শ্রী ভাদুড়ী
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অফিস সহকারী পদে কর্মরত আছেন তাইফুল ইসলাম (৩৫)। তার স্ত্রীর দুটি কিডনি দুই বছর ধরে বিকল। তিনি বলেন, ‘সপ্তাহে দুই দিন সরকারি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করাতে খরচ হয় ১ হাজার ১২০ টাকা। মাসে কিডনি ডায়ালাইসিসে খরচ হয় ৬ হাজার ৭২০ টাকা। এর সঙ্গে ওষুধ, চিকিৎসক, যাতায়াত মিলিয়ে মাসে ২০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়ে যায় চিকিৎসার পেছনে। স্বল্প বেতনে চালাতে না পেরে এর মধ্যেই দেনায় জড়িয়ে গেছি। বেসরকারি হাসপাতালে এ খরচ দ্বিগুণেরও বেশি। কতদিন চালাতে পারব জানি না।’
কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. শেখ মইনুল খোকন বলেন, ‘কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিস এবং ট্রান্সপ্লান্ট হলে চিকিৎসা নিরবচ্ছিন্ন চালিয়ে যেতে হয়। কিডনি ডায়ালাইসিস করতে রোগীকে নিয়ে আসতে যেতে আরেকজনকে আসতে হয়। রোগী নিজেও কর্মক্ষম থাকে না, আবার পরিবারের আরেকজন কর্মক্ষম ব্যক্তি তার জন্য ব্যস্ত থাকতে হয়। আমাদের কাছে অনেক রোগী শুরুতে কেবিন নিয়ে চিকিৎসা করে কিন্তু একটা সময় তারা খরচ চালাতে না পেরে বিনামূল্যের শয্যা চায়। আমরা ভর্তুকি দিয়ে হলেও রোগী না পারলে তাকে ডায়ালাইসিস দিয়ে থাকি। কিন্তু এটাকে তো সারা দেশের চিত্র বলা সম্ভব না।’
প্রতি বছর দেশে প্রায় দুই কোটি মানুষ কিডনির বিভিন্ন রোগে ভুগছেন। এসব রোগীর মধ্যে ৪০ হাজার রোগীর কিডনি বিকল হয় প্রতি বছর। এ পরিস্থিতিতে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব কিডনি দিবস। খাদ্যাভ্যাস, ফসলে অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার, খাদ্যে ভেজাল, অতিরিক্ত ওষুধ সেবনকে কিডনি রোগের জন্য দায়ী করছেন চিকিৎসকরা। ডায়াবেটিস ও হাইপার টেনশনে থাকা মানুষের কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। বাংলাদেশ রেনাল ফাউন্ডেশনের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, প্রতি বছর বিশ্বের ৮৫ কোটি মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়। এদের মধ্যে ২৪ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। তাই কিডনি প্রতিস্থাপনকে সমাধানের পথ হিসেবে মনে করছেন চিকিৎসকরা। কিন্তু সেখানেও রয়েছে কিডনির অপ্রতুলতা। রোগী ও স্বজনদের সর্বস্বান্ত করে দেয় এ রোগের চিকিৎসা ব্যয়। কিডনি অকেজো হওয়ার পর ডায়ালাইসিস করে বেঁচে থাকতে কিডনি রোগীদের ১২-২২ শতাংশের সম্পদ বিক্রি করে দিতে হচ্ছে। দেশের কিডনি রোগীদের মোট এক শতাংশেরও কম কিডনি প্রতিস্থাপনের সুবিধা রয়েছে। তবে কিডনি রোগটি প্রাথমিক অবস্থায় নিরূপণ করতে পারলে চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় নেফ্রলজিস্ট নেই। চিকিৎসা ব্যয় বেশি হওয়ায় অনেকেই মধ্যপথে বন্ধ করে দিচ্ছে চিকিৎসা। সচেতনতা, চিকিৎসক ও চিকিৎসার পর্যাপ্ততা এবং মৃত ব্যক্তির কিডনি সংগ্রহে সচেতনতার অভাব রয়েছে। গত বছর সারাহ ইসলাম তার দুটি কিডনি ও কর্নিয়া দান করে চারজন মানুষকে সুস্থ জীবন ফিরিয়ে দিয়েছেন। গত জানুয়ারিতে ব্রেন ডেথ রোগী মাসুম আলম তার দুটো কিডনি দান করলে জীবন বাঁচে আরও দুজন মানুষের। তাদের এই অঙ্গপ্রতঙ্গ দান অন্যদের আলোড়িত করলে আরও অনেকের জীবন বাঁচানো সম্ভব বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ), সিকেডি ও বাংলাদেশ কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতালে সফলতার সঙ্গে কিডনি প্রতিস্থাপনের কার্যক্রম চলমান আছে। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই-মাহবুব বলেন, ‘নৈতিকতার দিক থেকে কিডনি বেচাকেনা কোনো দেশই গ্রহণ করে না। উন্নত বিশ্বেও এটা ভলান্টারিভাবে হয়। কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করতে গেলে প্রথম দরকার কিডনির সহজলভ্যতা। কিডনি না পাওয়া গেলে ট্রান্সপ্লান্ট করা কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু বিদেশে কোনো ডোনার নিয়ে গেলে তারা অতবেশি নৈতিকতা দেখে না। তারা ডোনার ও অর্থ পেলে ট্রান্সপ্লান্ট করে দেয়। সম্প্রতি দেশে মরণোত্তর কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু হয়েছে। এটাকে ইতিবাচক ভাবে প্রচার করে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।’