দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট শুরু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের আহবানে শিক্ষকরা কর্মবিরতি পালন শুরু করেন।বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ‘বৈষম্যমূলক’ পেনশন ব্যবস্থার আওতা থেকে বাদ দেয়ার দাবিতে, বাংলাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীরা অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট শুরু করেছেন। এর ফলে, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের আহবানে শিক্ষকরা কর্মবিরতি পালন শুরু করেন। ১ জুলাই, ২০২৪।
ঢাকাঃ নতুন সর্বজনীন পেনশন স্কিম ‘প্রত্যয়’কে বৈষম্যমূলক ও কম সুবিধার মনে করছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা৷ তাই প্রচলিত সরকারি পেনশনে থাকার দাবিতে সোমবার থেকে সর্বাত্মক কর্মবিরতি শুরু করেছেন তারা৷ এই কর্মবিরতির কারণে ৫৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস, পরীক্ষা, প্রশাসনিক কার্যক্রমসহ সব ধরনের অ্যাকাডেমিক কাজ অচল হয়ে পড়েছে৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের কর্মসূচিও সোমবার সীমিত আকারে পালন করা হয়েছে৷ ওই কর্মসূচিতে প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা শিক্ষক ছাড়া আর কোনো শিক্ষকদের দেখা যায়নি৷ ৫৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রয়েছেন ১৬ হাজারের কিছু বেশি৷ কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংখ্যা ৩৪ হাজার৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে অনেক শিক্ষার্থীর উপস্থিতি দেখা যায়৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস
দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে সব বিশ্ববিদ্যালয়েই ক্লাস,পরীক্ষা ও অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ আছে৷ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অফিসার ও কর্মচারী সমিতিও শিক্ষকদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে কর্মবিরতিতে গেছেন৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি খোলার দাবিতে শিক্ষার্থীরা সোমবার লাইব্রেরির সামনে ইটপাটকেল ছুঁড়েছেন৷
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের ব্যানারে দাবি না মানা পর্যন্ত অনির্দিষ্টকালের জন্য এই কর্মবিরতি চলবে বলে জানিয়েছেন ফেডারেশনের সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. নিজামুল হক ভুঁইয়া৷ তারা সর্বজনীন পেনশন ‘প্রত্যয়’-এর প্রজ্ঞাপন বাতিল ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সুপার গ্রেডে অন্তর্ভুক্তি এবং শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল চালুর দাবিতে কর্মবিরতি শুরু করেছেন৷
পেনশন অসন্তোষে বাংলাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বাত্মক কর্মবিরতির ডাক
‘আমরা আগের সরকারি পেনশনেই থাকতে চাই’
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. মমিন উদ্দিন বলেন, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্ত করার প্রজ্ঞাপন জারির পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ জন অধ্যাপকের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়৷ ওই কমিটি বৈষম্যের জায়গাগুলো স্পষ্ট করেছে৷ ওই প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেয়া হয়েছে৷ প্রতিবেদনের সঙ্গে আমরা সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা একমত৷ তাই আমরা আন্দোলন শুরু করেছি৷ আমরা আগের সরকারি পেনশনেই থাকতে চাই৷”
তিনি জানান, ‘‘এখন যে সরকারি নিয়মে আমরা পেনশন পাই তাতে আমাদের বেতন থেকে কোনো টাকা কাটা হয় না৷ পুরোটাই সরকার বহন করে৷ কিন্তু নতুন নিয়মে আমাদের বেতনের শতকরা ১০ ভাগ কেটে রাখা হবে৷ আর একজন অধ্যাপক অবসরের সময় গ্রাচুইটি হিসেব এককালীন ৮০ লাখ টাকা পান৷ উনি যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন পেনশন পাবেন৷ মারা যাওয়ার পর তার স্ত্রী বা স্বামী মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত ওই পেনশন পাবেন৷ কিন্তু নতুন নিয়মে গ্রাচুইটি নাই৷ আবার ৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত পেনশন দেয়া হবে৷ পেনশন ভোগীর স্বামী বা স্ত্রীর ক্ষেত্রেও তাই৷”
তার কথা, ‘‘এই নতুন পেনশন এখন থেকে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় যোগ দেবেন তাদের জন্য কার্যকর হবে৷ আমরা অধ্যাপকেরা অবসরে গেলে পেনশন পাবো সরকারি নিয়মে মাসিক ৪৫ হাজার টাকা করে৷ কিন্তু এখন লেকচারার হিসেবে যোগ দিয়ে যারা অবসরে যাবেন তারা বেতনের ১০ শতাংশ করে দিয়ে অধ্যাপক হওয়ার পর অবসরে গেলে মাসে পাবেন এক লাখ ২৪ হাজার টাকা করে পেনশন৷ আমরা হিসাব করে দেখেছি তারা চাকরি জীবনে যে পরিমাণ টাকা দেবেন তা ব্যাংকে রাখলে যে আসল ও প্রিমিয়াম পাবেন তাও সম পরিমাণ৷
‘‘ফলে নতুন পেনশনে নানা দিক থেকেই আমাদের সুবিধা কমিয়ে দেয়া হচ্ছে৷ এবং এটা বৈষ্যম্যমূক৷ এটা আমাদের ওপর প্রভাব না ফেললেও নতুন যারা আসবেন তাদের ওপর প্রভাব ফেলবে৷ সরকারি চাকরি বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার একটি বিষয় হলো অবসর জীবনে একটু ভালো থাকা, নিশ্চিত থাকা৷ কিন্তু এরকম হলে তো মেধাবীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেশায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন,” যোগ করেন তিনি৷
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন, ‘‘নতুন পেনশন ব্যবস্থায় আমাদের অন্তর্ভূক্ত করার প্রজ্ঞাপন জরি করে আমাদের ক্ষতির মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে৷ বিষয়টি নিয়ে আমাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনাও করা হয়নি৷ আমাদের কাছ থেকে নেয়া টাকাই আসলে সুদসহ আমাদের ফেরত দেয়া হবে৷ এখানে সরকারের কোনো অংশগ্রহণ আসলে থাকবে না৷ এটা নিরাপত্তাহীনতাও তৈরি করবে৷”
‘‘আর নতুন নিয়মে অবসরের বয়স বলা হয়েছে ৬০ বছর৷ কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবসরের বয়স ৬৫ বছর৷ অর্জিত ছুটির বিপরীতে টাকা পাওয়ার ব্যবস্থা নাই৷ বছরে পেনশন পাঁচ শতাংশ হারে বাড়ে৷ নতুন নিয়মে বাড়বে না৷ অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটির ব্যাপারে কিছু বলা নাই৷ মাসিক চিকিৎসা ভাতা, উৎসব ভাতার ব্যাপারে কিছু বলা নেই,” জানান তিনি৷
তিনি বলেন, ‘‘এই পরিস্থিতি নিয়ে আমরা আমাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের একাধিক বৈঠকে আলোচনা ও বিশ্লেষণ করে চূড়ান্ত পর্যায়ে আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি৷”
অর্থ বিভাগ গত ১৩ মার্চ সর্বজনীন পেনশন কর্সসূচি ‘প্রত্যয়ের’ প্রজ্ঞাপন জারি করে৷ এই কর্মসূচি বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ), ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশসহ (আইসিবি) সব রাষ্ট্রমালিকানাধীন ও সরকারি ব্যাংক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, সাধারণ বীমা করপোরেশনসহ সব করপোরেশন, পেট্রোবাংলা, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি), বিএসটিআইসহ প্রায় ৪০০ সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের নতুন কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য৷ ১ জুলাই সোমবার থেকে এটা কার্যকর করা হয়েছে৷ ১ জুলাই থেকে যারা এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে যোগ দেবেন তারা এই নতুন পেনশনের আওতায় পড়বেন৷
‘এটা অবশ্যই বৈষ্যম্যমূলক’
সর্বাত্মক কর্মবিরতিতে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বন্ধ ক্লাস-পরীক্ষা | desherkantha
এদিকে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখনো প্রচলিত সরকারি পেনশন নীতির আওতায়ই আছেন৷ তবে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী তার বাজেট বক্তৃতায় সরকারি চাকরিজীবীদেরও সর্বজনীন পেনশনের আওতায় আনার কথা বলেছেন৷ সেটা ২০২৫ সালের ১ জুলাই থেকে চালু হবে৷ তার নাম হবে ‘সেবক’৷
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক নিজামুল হক ভুঁইয়া বলেন, ‘‘সরকারি চাকরিজীবীদের আগামী বছর সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় নেয়া হবে৷ তাদেরটার নাম হবে সেবক৷ তাদের জন্য আলাদা কেন? আর এক বছর পরে কেন? আমাদেরও সরকার সেবকে নিক এবং একই সময়ে নিতো৷ আমাদের ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া হলো কেন? এসব কী? এর নিশ্চয়ই ভিন্ন উদ্দেশ্য আছে৷ এটা অবশ্যই বৈষ্যম্যমূলক৷”
তার কথা, ‘‘আমরা এই পেনশনে যে ক্ষতি ও বৈষম্য তা গবেষণা করে সরকারকে জানিয়েছি৷ শিক্ষামন্ত্রী এবং শিক্ষামন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সঙ্গে দেখা করেছি৷ কিন্তু আমরা কোনো সমাধান পাইনি৷ তাই বাধ্য হয়ে আমরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা সর্বাত্মক কর্মবিরতি শুরু করেছি৷ আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এই কর্মবিরতি চলবে৷ এটা আমাদের মর্যাদা এবং অস্তিত্বের প্রশ্ন৷”
এদিকে সরকারের দিক থেকে এই কর্মবিরতির ব্যাপারের কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া সোমবার পাওয়া যায়নি৷ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কোনো প্রতিক্রিয়া জানাতে অপারগতা প্রকাশ করে৷ তবে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী রোববার এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘পেনশন বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তটি শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নয়, সব স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের জন্য৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আলাদা কিছু করতে হলে সেইভাবেই অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে৷” সর্বাত্মক কর্মবিরতির ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অচলবস্থা হলে কী হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘গণতান্ত্রিক দেশে সবার রাজনীতি ও বাকস্বাধীনতার অধিকার আছে৷ পরিস্থিতি বিবেচনায় ব্যবস্থা নেয়া হবে৷”
চারটি আলাদা কর্মসূচি নিয়ে সর্বজনীন পেনশন শুরু হয় গত বছরের ১৭ আগস্ট থেকে৷ এগুলো হলো প্রগতি, সুরক্ষা, প্রবাস ও সমতা৷ কর্মসূচিগুলোর আওতায় এখন পর্যন্ত তিন লাখ ৩২ হাজার ৭৭৩ জন গ্রাহক হয়েছেন৷ জমা পড়েছে ৯৭ কোটি টাকা৷ আর ১ জুলাই থেকে শুরু হলো আরেকটি স্কিম প্রত্যয়৷