ইসরায়েলের পার্লামেন্ট, নেসেটে, দখলকৃত পশ্চিম তীরকে ইসরায়েলের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার একটি বিতর্কিত বিল প্রথম ধাপে পাস হয়েছে। এই বিলটি পূর্ণাঙ্গভাবে পাস হলে, পশ্চিম তীরের ওপর ইসরায়েলের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে, যা আন্তর্জাতিক আইন ও ফিলিস্তিনি অধিকারের বিরুদ্ধে একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
মঙ্গলবার, ১২০ আসনের নেসেটে ২৫-২৪ ভোটে বিলটি প্রাথমিকভাবে পাস হয়। এ বিলটি এখনো আরও তিন ধাপের ভোট প্রক্রিয়ায় যেতে হবে, যাতে এটি পূর্ণাঙ্গভাবে আইন হিসেবে কার্যকর হতে পারে। পার্লামেন্টে এই বিলের প্রতি নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন লিকুদ পার্টির বিরোধিতা সত্ত্বেও, কয়েকজন জোটসঙ্গী এবং বিরোধী এমপির সমর্থন লাভ করেছে।
এতে বলা হয়েছে যে, ইসরায়েল রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব পশ্চিম তীরের জুদিয়া ও সামারিয়া অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হবে। পরবর্তী সময়ে এই বিলটি সংসদের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা কমিটিতে আরও আলোচনা এবং পর্যালোচনার জন্য পাঠানো হবে।
বিলটি পাস হওয়ার পর, ফিলিস্তিন, হামাস, কাতার, সৌদি আরব, এবং জর্ডানসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহল তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। ফিলিস্তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, “আমরা এই বিলের প্রতি পূর্ণ বিরোধিতা জানাই। পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম এবং গাজা একক ভৌগোলিক ইউনিট, যা ফিলিস্তিনের মালিকানাধীন। ইসরায়েলের এখানে কোনো সার্বভৌম অধিকার নেই।”
হামাসও এক বিবৃতিতে এই বিলকে “ইসরায়েলের উপনিবেশবাদী প্রকৃতির প্রকাশ” বলে অভিহিত করেছে এবং এর বিরুদ্ধে “যুদ্ধ” চালানোর হুঁশিয়ারি দিয়েছে। কাতার এই পদক্ষেপকে “ফিলিস্তিনিদের ঐতিহাসিক অধিকারের প্রকাশ্য লঙ্ঘন” হিসেবে উল্লেখ করেছে এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি চ্যালেঞ্জ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, “ইসরায়েলের দখলকৃত ভূমিতে বসতি স্থাপন ও সম্প্রসারণমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সৌদি আরব কঠোর অবস্থান গ্রহণ করছে।” জর্ডানও এক বিবৃতিতে বলেছে, “এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইনের প্রতিকারযোগ্য লঙ্ঘন এবং দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের পথে বাধা সৃষ্টি করবে।”
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এই বিলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন, যদিও তাঁর নেতৃত্বাধীন লিকুদ পার্টি বিলটি সমর্থন করেছে। নেতানিয়াহু এ বিলের বিরোধিতা করে বলেন, “এ ধরনের পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি জটিল করে তুলবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।” তাঁর মতে, ইসরায়েলের সার্বভৌমত্ব প্রকৃত পদক্ষেপের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে, শুধুমাত্র আইনগত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নয়।
এই বিলটি পাস হওয়ার প্রেক্ষিতে মার্কিন প্রশাসনও অবগত হয়েছে। এক মাস আগে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছিলেন যে, পশ্চিম তীরের কোন অংশ ইসরায়েলের সঙ্গে সংযুক্তির অনুমতি দেওয়া হবে না। একই সময়ে, মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ইসরায়েল সফর করছেন, যেখানে গাজায় যুদ্ধবিরতি স্থায়ী রাখতে আলোচনা চলছে।
বর্তমানে পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে সাত লাখেরও বেশি ইসরায়েলি বসতি স্থাপন করেছে, যা আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ হিসেবে চিহ্নিত। এই বসতি স্থাপন এবং সম্প্রসারণ ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে একটি দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক বিরোধের প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। পশ্চিম তীরকে ইসরায়েলের সঙ্গে সংযুক্ত করার প্রস্তাব, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের সম্ভাবনাকে আরও কঠিন করে তুলবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন।
পশ্চিম তীরকে ইসরায়েলের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার এই উদ্যোগটি শুধুমাত্র ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধির ঝুঁকি তৈরি করবে না, বরং এটি আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সম্পর্কেও গভীর প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশ্বের প্রধান শক্তির সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্কের ওপর এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পরতে পারে। এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোও এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান আরো কঠোর করতে পারে।
এই বিলটি যদি পরবর্তীতে পূর্ণাঙ্গভাবে পাস হয়, তবে তা শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক পদক্ষেপের চেয়ে অনেক বড় একটি পরিবর্তন আনবে, যা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, শান্তি প্রক্রিয়া এবং ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের ওপর নতুন প্রশ্ন তোলবে।