জাতিসংঘের ৮০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষ্যে দেওয়া এক বাণীতে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, বিশ্ব শান্তি ও বহুপাক্ষিক সহযোগিতার লক্ষ্য অর্জনে জাতিসংঘকে ক্রমাগত বিকশিত এবং পরিবর্তিত বিশ্ব বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কাজ করতে হবে।
২৪ অক্টোবর, জাতিসংঘ দিবস উপলক্ষ্যে দেওয়া বাণীতে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “যদি জাতিসংঘ আমাদের সবার শান্তি ও বহুপাক্ষিক সহযোগিতার আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করতে চায়, তবে তাকে অবশ্যই বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির সঙ্গে অভিযোজিত হতে হবে।” তিনি জাতিসংঘ সংস্কারের পক্ষে কথা বলেন, যাতে এটি আরও গতিশীল এবং পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সবার প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হয়।
এ বছর জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠার ৮০ বছর পূর্ণ হচ্ছে। এই ঐতিহাসিক দিনটিতে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “এই তাৎপর্যপূর্ণ দিনে আমরা পুনরায় অঙ্গীকার করছি যে, জাতিসংঘ সনদে প্রতিশ্রুত শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল বিশ্ব গড়ে তুলতে বাংলাদেশ তার দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখবে।” তিনি জাতিসংঘ দিবস উপলক্ষ্যে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রসমূহ, তার অংশীদার এবং সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে শুভেচ্ছা জানান।
অধ্যাপক ইউনূস আরও বলেন, “আজকের দিনটি বিশ্বজুড়ে শান্তি ও বহুপাক্ষিক সহযোগিতার প্রতি আমাদের অঙ্গীকার নতুন করে স্মরণ করার একটি সুযোগ।” তিনি জাতিসংঘের বহুপাক্ষিক সহযোগিতা ও ঐকমত্যের চেতনার গুরুত্বের উপরও আলোকপাত করেন, যা বিশ্বে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখছে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, গত আট দশকে জাতিসংঘ তার কার্যক্রমের পরিধি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করেছে এবং বিশ্বজুড়ে এর সম্পৃক্ততা আরও গভীর হয়েছে। জাতিসংঘ শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা, মানবাধিকার সুরক্ষা এবং টেকসই উন্নয়ন ও মানবকল্যাণে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে।
বাংলাদেশের জাতিসংঘে যোগদানের পর থেকে দেশটি একটি সক্রিয়, দায়িত্বশীল এবং অবদানশীল সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে, মন্তব্য করেন অধ্যাপক ইউনূস। তিনি বলেন, ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের পর বাংলাদেশ শান্তির সংস্কৃতির পতাকা হাতে নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শান্তিরক্ষা মিশনগুলোতে অংশগ্রহণ করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনগুলোর মধ্যে একটি শীর্ষ অবদানকারী দেশ হিসেবে রয়েছে।
অধ্যাপক ইউনূস আরও বলেন, “আমাদের অনেক সাহসী শান্তিরক্ষী বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করেছেন।” তিনি জানান, বাংলাদেশের শান্তিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরা বিশ্বজুড়ে শান্তিরক্ষা মিশনে বিশেষ ভূমিকা পালন করছেন, যা আন্তর্জাতিক শান্তি রক্ষায় বাংলাদেশের অবদানের প্রমাণ।
তবে তিনি কিছু উদ্বেগও প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “বর্তমান বিশ্বে একতরফা সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বৈষম্যমূলক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের কারণে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।” এই ধরনের পরিস্থিতি বিশ্বে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা বহুপাক্ষিক কূটনীতির জন্য এক কঠিন পরীক্ষা সৃষ্টি করেছে।
অধ্যাপক ইউনূস আরও উল্লেখ করেন, সাম্প্রতিক সংঘাতসমূহ বিশেষ করে গাজায় চলমান মানবিক সঙ্কট বিশ্বকে গভীর অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। তিনি বলেন, “আজকের দিনে আমরা গাজার ভয়াবহ গণহত্যার সরাসরি সম্প্রচার দেখছি, যা মানবিক কষ্টের চরম উদাহরণ।”
বাংলাদেশের নিজের অঞ্চলেও মানবাধিকার ও শরণার্থী সংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন অধ্যাপক ইউনূস। তিনি রোহিঙ্গাদের অধিকারবঞ্চনা এবং নির্যাতনের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। “এটি সাংস্কৃতিক পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতির ফল,” বলেন তিনি, এবং এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নতুন মনোযোগ কামনা করেন।
অধ্যাপক ইউনূসের এই মন্তব্যগুলো জাতিসংঘ দিবসের গুরুত্ব এবং বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে গভীর চিন্তা-ভাবনা তুলে ধরেছে। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের ভূমিকা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি, বহুপাক্ষিক সহযোগিতা ও আন্তর্জাতিক সংহতির প্রয়োজনীয়তার উপর তার বার্তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।