পাকিস্তান সরকার আফগানিস্তানের সঙ্গে সকল সীমান্ত ক্রসিং এবং বাণিজ্য অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছে। গতকাল (১৮ অক্টোবর) পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র তাহির হুসাইন আন্দারবি এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন। তিনি জানান, সীমান্ত ক্রসিং ও বাণিজ্য বন্ধ থাকবে নিরাপত্তা পরিস্থিতির মূল্যায়ন না হওয়া এবং পরবর্তী নির্দেশনা না আসা পর্যন্ত।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, “পাকিস্তানের নাগরিকদের নিরাপত্তা আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আফগানিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য যতটা গুরুত্বপূর্ণ, ততটা নিরাপত্তাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিরাপত্তা পরিস্থিতির মূল্যায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত কার্যকর থাকবে।”
পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছে যে, আফগানিস্তানে তালেবান সরকার পাকিস্তানের নিষিদ্ধ রাজনৈতিক গোষ্ঠী তেহরিক-ই তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)-কে মদত দিয়ে আসছে। তবে, আফগানিস্তান এই অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে।
গত ৯ অক্টোবর, আফগানিস্তানের বিমানবাহিনী কাবুলে পাকিস্তান-ভিত্তিক টিটিপির শীর্ষ নেতা নূর ওয়ালি মেহসুদ এবং তার সহযোগীদের ওপর বিমান হামলা চালায়, যাতে তারা নিহত হয়। এই হামলা পাকিস্তানের জন্য ‘দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত’ হিসেবে বিবেচিত হয় এবং এর পরই পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ১১ অক্টোবর আফগান সেনাবাহিনীর ওপর পাল্টা হামলা চালায়। এই সংঘর্ষে আফগান বাহিনীর ২০০ সেনা নিহত হয় এবং পাকিস্তানের ২৩ সেনা নিহত হয়। টানা ৪ দিন চলা এই সংঘর্ষের পর, ১৫ অক্টোবর দুই পক্ষ যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে এবং ১৭ অক্টোবর কাতারের রাজধানী দোহায় এক বৈঠকের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়ানো হয়।
পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক সীমান্ত ক্রসিং হলো তোরখাম। এই সীমান্ত দিয়ে সাধারণত হাজার হাজার ট্রাক দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য করতে প্রবেশ করে। তাছাড়া, তাজা ফল, শাক-সবজি, গম, চাল, মাংস, দুধ এবং বিভিন্ন খনিজ পদার্থও প্রবাহিত হয়। এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে তোরখাম সীমান্তের দু’পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রায় ৫ হাজার ট্রাক, যেগুলো সীমান্ত খোলার অপেক্ষায় রয়েছে।
সীমান্তের বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। পাকিস্তানের বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ানো এক অন্যতম প্রভাব। বিশেষ করে, টমেটোর দাম গত কয়েক দিনে পাঁচগুণ বেড়ে গেছে। এতে সাধারণ জনগণের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, এবং বাজারে পণ্য সংকট দেখা দিচ্ছে।
পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে প্রতি বছর প্রায় ২৩০ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়। সীমান্ত বন্ধ থাকার ফলে দুই দেশের অর্থনীতিতে তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়েছে। বিশেষত, দুই দেশের মধ্যে খাদ্য এবং অপরিহার্য পণ্যগুলির অভাব দেখা দিয়েছে, যা স্থানীয় বাজারে সংকট সৃষ্টি করেছে।
আফগানিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত সম্পর্কের অবনতির ফলে পাকিস্তান সরকার অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তবে, পাকিস্তান সরকার জানিয়ে দিয়েছে যে, সীমান্ত সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের জন্য পরবর্তী নিরাপত্তা মূল্যায়ন করা হবে এবং দুই দেশের মধ্যে আলোচনা অব্যাহত থাকবে।
পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক একাধিকবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, এবং এখন এই নতুন নিরাপত্তা পরিস্থিতি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তে বাণিজ্য স্থগিতের সিদ্ধান্তে দুই দেশের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভবিষ্যত নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের মধ্যে চলমান উত্তেজনা এবং বাণিজ্য বন্ধের সিদ্ধান্ত দুটি দেশেই অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পরিবর্তন আনতে পারে। দুই দেশের সীমান্তে যেসব ট্রাক আটকে রয়েছে, তার মধ্যে অনেক ট্রাকের চালকরা সীমান্ত খোলার অপেক্ষায় রয়েছেন। এছাড়া, পাকিস্তানের বাজারে দাম বৃদ্ধি এবং পণ্য সংকটও সাধারণ মানুষের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতি যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে দুই দেশের অর্থনীতির উপর বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে।