সাহাদাত হোসেন পরশ ও আতাউর রহমান ;নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়া অনেকেই এখন চরম আতঙ্কে। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পর গ্রেফতার আতঙ্ক ছাড়াও তাদের মধ্যে সম্পদ জব্দ হওয়ার ভীতি কাজ করছে। এরই মধ্যে বহিস্কৃত যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, জি কে শামীমসহ বেশ কয়েকজনের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য বের করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তাদের সম্পদের হিসাব চেয়ে অন্তত ১০টি সংস্থাকে চিঠি দিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। চিঠিতে খালেদ ও শামীমের স্ত্রী, আত্মীয় ও ঘনিষ্ঠজনদের নাম রয়েছে। বৈধ উৎসের বাইরে তাদের জ্ঞাত-অজ্ঞাত সম্পদের অমিল পাওয়া গেলে তাদের সব সম্পদ জব্দ করা হবে। একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
এদিকে চলমান ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান গত কয়েক দিনে কিছুটা গতি হারিয়েছে। ২৫ সেপ্টেম্বরের পর গত চার দিনে দেশের কোথাও ছোট-বড় ধরনের কোনো অভিযান চালাতে দেখা যায়নি। সর্বশেষ রাজধানীর মণিপুরিপাড়ায় অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছিল মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সভাপতি লোকমান হোসেন ভূঁইয়াকে।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু করে র্যাব। এরপর সারাদেশে র্যাব-পুলিশের অন্তত ৩৫টি অভিযানে ২৭০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের মধ্যে রয়েছেন যুবলীগ ও কৃষক লীগের তিন শীর্ষ নেতা। তবে এখনও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটসহ নেপথ্যের অনেক রাঘববোয়াল অধরা রয়েছেন।
জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সমকালকে বলেন, ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে বাসাবাড়িতে কোটি কোটি টাকা পাওয়ায় দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের চিত্রই উঠে এসেছে। এক্ষেত্রে অবৈধ কারবারিদের সঙ্গে রাজনীতি আর প্রশাসন যুক্ত হয়ে কাজ করায় দুর্নীতিটা বড় হয়েছে।
তিনি বলেন, অভিযানটা ভালো। তবে ক্যাসিনো বা অবৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদের মালিকদের পেছনে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। জড়িত সবার বিচার করা না হলে কাঙ্ক্ষিত সুফল মিলবে না।
বিশিষ্ট আইনজীবী মনজিল মোরসেদ সমকালকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের ঘোষণা দিয়েছেন। এই দুর্নীতি রোধ করতে গিয়ে ক্যাসিনো-জুয়া সামনে চলে এসেছে। কারণ দুর্নীতি করে অঢেল টাকার মালিক হওয়ায় সেই টাকা দিয়েই ক্যাসিনো খেলা হয়েছে। সেই টাকাই আবার অনেকের পকেটে গেছে।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর মেসেজটা সবাইকে বুঝতে হবে। এটাকে রাজনীতিকরণের কিছু নেই। কারও ওপর দোষ চাপানোরও কিছু নয়। যে দোষী তাকেই আইনের আওতায় নিতে হবে। আইন ভঙ্গ করে, ক্ষমতা দেখিয়ে কিছু করার প্রবণতা বন্ধ করতে পারলেই সবার জন্য মঙ্গল হবে।
সিআইডির ডিআইজি ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, চলমান অভিযানে এখন পর্যন্ত মানি লন্ডারিং আইনে চারটি মামলা হয়েছে। এই মামলার তদন্ত শুরু হয়েছে। খালেদ, শামীমসহ কয়েকজনের সম্পদের হিসাব জানতে বিভিন্ন সংস্থাকে দেওয়া হয়েছে চিঠি। বিদেশে তাদের সম্পদ রয়েছে কি-না, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সংশ্নিষ্ট একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, এরই মধ্যে খালেদ, শামীম ও সূত্রাপুরের দুই ভাই এনামুল হক ওরফে এনু ভূঁইয়া, রুপন ভূঁইয়া এবং মোহামেডান ক্লাবের সভাপতি লোকমান হোসেন ভূঁইয়ার ব্যাপারে পাওয়া তথ্যে গোয়েন্দারা নিশ্চিত যে, অবৈধ উপায়ে তারা সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। ক্যাসিনো ও ঠিকাদারির একটি সিন্ডিকেট তারা তৈরি করেছেন। সেই সিন্ডিকেটের সদস্যরা রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক হন।
তিনি জানান, খালেদ-শামীমের সূত্র ধরে অনেক সরকারি কর্মকর্তার নামও আসছে। তাদেরও আইনের মুখোমুখি করা হবে। খালেদ, শামীম ও লোকমানের নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার সম্পদ থাকার তথ্য মিলেছে।
তবে এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় ঘাপলা রেখে যাতে তাদের পার পেতে কেউ সহায়তা করতে না পারে, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকার কথা বলছেন অনেকে। এদিকে, এই শুদ্ধি অভিযানের ভবিষ্যৎ টার্গেট কারা, তা নিয়ে রয়েছে নানা গুঞ্জন। অভিযানের পরিধি বাড়িয়ে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের গ্রেফতার করা হতে পারে বলে একাধিক সূত্র থেকে আভাস মিলেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করতে দেখা যায়নি। এ ছাড়া যুবলীগ নেতা সম্রাটের ভবিষ্যৎ নিয়ে সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে রয়েছে নানা সংশয়। পাঁচ-ছয় দিন ধরে সম্রাটের অবস্থান নিয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য নেই। তবে একাধিক গোয়েন্দা সূত্র নিশ্চিত করেছে, সম্রাট দেশে রয়েছেন। তিনি নজরদারিতে আছেন। ‘সবুজ সংকেত’ পেলেই তাকে গ্রেফতার করা হবে।
যুবলীগের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রোববারও সম্রাটের সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ হয়নি। তিনি কোথায় রয়েছেন, তাও তারা জানেন না। তবে শনিবার পর্যন্ত সম্রাটকে ফেসবুকে সক্রিয় থাকতে দেখা যায়। তবে তার ফেসবুক অন্য কেউ ব্যবহার করছেন কি-না, সেটা নিয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য নেই নেতাকর্মীদের।
র্যাবের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তারা যে কাউকে গ্রেফতার করবেন। সেখানে কারও পরিচয় মুখ্য নয়। ক্যাসিনো থেকে যারা অবৈধভাবে লাভবান হয়েছে, তাদের তালিকা তৈরি করা হবে।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, ক্যাসিনোসহ চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অসাধু সদস্যদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশের কিছু অসাধু সদস্যের নাম পাওয়া গেছে। এরপর তাদের ব্যাপারে তদন্ত শুরু হয়। অভিযোগ প্রমাণ হলে তারা শাস্তির মুখোমুখি হবেন। তবে ক্যাসিনো ‘ঝড়ের’ পর দুই পুলিশ সদস্যকে সাসপেন্ড ও দু’জনকে স্ট্যান্ডরিলিজ করা হয়েছে।
এনামুল বিদেশে, দেশে থেকেও অধরা রুপন :পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়া ও ওয়ারী এলাকার বাসায় র্যাবের অভিযানের আগেই পালিয়েছিলেন ক্যাসিনো হোতা দুই ভাই এনামুল হক ওরফে এনু ভূঁইয়া ও রুপন ভূঁইয়া। এর মধ্যে এনু ভূঁইয়া দেশ ছাড়লেও রুপন ভূঁইয়া দেশেই আত্মগোপনে আছেন। ক্যাসিনো-কাণ্ডে তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় সাতটি মামলা হয়েছে। কিন্তু তাদের কাউকেই আইনের আওতায় আনা যায়নি। ওই দুই ভাইয়ের অপকর্মের সহযোগীদেরও গ্রেফতার করা যায়নি।
এনু ভূঁইয়া গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও রুপন একই ইউনিটের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। গত মঙ্গলবার র্যাব তাদের বাড়িসহ অপর দুটি আস্তানায় অভিযান চালিয়ে পাঁচ কোটি টাকা, ৭২০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ও ছয়টি আগ্নেয়াস্ত্র জব্দ করে। পরে ওই দুই ভাইসহ তাদের দুই সহযোগী আবুল কালাম ও হারুন অর রশিদের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে ওয়ারী, গেণ্ডারিয়া ও সূত্রাপুর থানায় পৃথক সাতটি মামলা হয়।
র্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, মতিঝিলের বিভিন্ন ক্লাব ভাড়া নিয়ে এনু ও রুপন ক্যাসিনো চালিয়ে আসছিলেন। ওয়ান্ডারার্স ক্লাব ও আরামবাগ ক্লাব তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ক্লাবগুলোতে র্যাবের অভিযানের মুখে তারা লোহার সিন্দুক কিনে এসব টাকা নিজেদের ফ্ল্যাট এবং দুই সহযোগী কালাম ও হারুনের বাসায় রেখেছিলেন।
র্যাবের দেওয়া তথ্যের সূত্র ধরে গেণ্ডারিয়া ও ওয়ারীর স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এনু ভূঁইয়া ও রুপন ভূঁইয়াদের পরিবার পুরনো জুয়াড়ি হিসেবে চিহ্নিত। একসময়ে পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ও মেলায় তারা হাউজি জুয়া চালালেও কয়েক বছর ধরে মতিঝিল ক্লাবপাড়ায় তার বিস্তৃতি ঘটায়। সর্বশেষ জুয়ার আধুনিক ক্যাসিনো মেশিন নিয়ে আসে। গত তিন বছরে পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ১৫টি বাড়ি তৈরি করে ওই দুই ভাই। দামি গাড়িতে চলার পাশাপাশি টাকার বিনিময়ে তাদের পরিবারের ৯ জনই স্থানীয় আওয়ামী লীগের নানা পদ বাগিয়ে নেয়।
স্থানীয়দের শঙ্কা, জুয়ার টাকায় অঢেল বিত্তবৈভবের মালিক এনু ভূঁইয়া ও রুপন ভূঁইয়ার পরিবার। এসব টাকা খরচ করে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে তারা গ্রেফতার এড়াতে পারে। অবশ্য র্যাব-৩-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল শাফীউল্লাহ বুলবুল বলেছেন, তাদের অভিযানের আগেই এনামুল হক ভূঁইয়া দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। রুপন ভূঁইয়া দেশেই রয়েছেন বলে তথ্য রয়েছে। তাকেসহ মামলার অন্য আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, ক্যাসিনো-কাণ্ডে বিভিন্ন প্রভাবশালী নেতার নাম এলেও তাদের নাম ভাঙিয়ে জুয়ার আসর বসাতেন এনামুল ও রুপনরা। ওই নেতারা বিনিময়ে দৈনিক ও মাসিক হিসেবে টাকা নিতেন। তাদের চিহ্নিত করতে তদন্ত চলছে। পুলিশের ওয়ারী বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, এনামুল ও রুপনের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মানি লন্ডারিং আইনে দায়ের মামলা তদন্ত করছে সিআইডি। অপর মামলাগুলো থানা পুলিশ তদন্ত করছে। তবে সব সংস্থাই আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চালাচ্ছে।