আন্তর্জাতিক ডেস্ক
গাজা উপত্যকার উত্তরে ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে দুই ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। ইসরায়েল দাবি করেছে, নিহত ব্যক্তিরা ‘সন্দেহজনক কিছু বস্তু’ বহন করছিলেন; তবে ওই বস্তুগুলো কী ছিল—তা এখনো তারা শনাক্ত বা প্রকাশ করেনি। সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতির পরও সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এমন সংঘর্ষ ও প্রাণহানির ঘটনা অব্যাহত থাকায় পরিস্থিতির অস্থিরতা আরও বাড়ছে।
গাজার উত্তরে হলুদ রেখা দিয়ে চিহ্নিত সীমান্তবর্তী বাফার জোনে প্রায়ই সংঘাত দেখা দেয়। যুদ্ধবিরতির পর থেকে ওই এলাকায় প্রবেশ বা চলাচল নিয়ন্ত্রণে ইসরায়েলি সেনারা কঠোর অবস্থান বজায় রেখেছে। এ সময় বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের সীমান্তসংলগ্ন অঞ্চলে উপস্থিতি বা নড়াচড়াকে ইসরায়েলি বাহিনী নিয়মিতভাবে সন্দেহজনক হিসেবে বিবেচনা করছে। নিহতদের ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে অভিযুক্ত করার ঘটনা একাধিকবার ঘটেছে, যদিও এসব অভিযোগের বিষয়ে কোনো স্বাধীন তদন্ত বা যাচাই-বাছাই সাধারণত প্রকাশ করা হয় না। ফলে ঘটনাগুলোকে ঘিরে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে।
গাজায় চলমান মানবিক ও পরিবেশগত সংকট আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সাম্প্রতিক স্যাটেলাইট বিশ্লেষণে। ২০২৫ সালের স্যাটেলাইট চিত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, টানা বিমান হামলা, গোলাবর্ষণ ও স্থল অভিযানের কারণে উপত্যকাজুড়ে অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। জাতিসংঘের গত বছরের একটি পর্যালোচনা প্রতিবেদনে গাজা জুড়ে প্রায় ৮১ শতাংশ কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। নতুন স্যাটেলাইট বিশ্লেষণ সেই পূর্ববর্তী আশঙ্কার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও প্রকটভাবে উপস্থাপন করেছে।
অবকাঠামোর ক্ষতি শুধুমাত্র ভবন বা সড়কপথেই সীমাবদ্ধ নয়; গাজার কৃষি খাতেও এর গভীর প্রভাব পড়েছে। জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থা এবং স্যাটেলাইট বিশ্লেষণ কেন্দ্রের যৌথ মূল্যায়নে দেখা গেছে, গাজা উপত্যকার বৃহৎ অংশের ফসলি জমি, ফলের বাগান এবং গ্রিনহাউস ক্ষতিগ্রস্ত বা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে। বিশেষ করে জলপাইচাষ এই অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ কৃষি কার্যক্রম হলেও ৭৫ শতাংশের বেশি জলপাইবাগান ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে।
গ্রিনহাউসসমূহের অবস্থাও একই রকম সংকটময়। প্রায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত গ্রিনহাউস ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সবজি ও ফল উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বহু কৃষক পরিবারের জীবিকা এবং স্থানীয় খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা এই উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল ছিল। ফলে গাজার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা আরও গভীরতর হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
উপত্যকার সেচব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাওয়াও বড় ধরনের উদ্বেগের বিষয়। সর্বশেষ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রায় ৮২.৮ শতাংশ কৃষি কূপ এবং সেচ কাঠামো অচল হয়ে পড়েছে। এই সেচব্যবস্থার ওপরই গাজার কৃষি উৎপাদন পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল। সেচব্যবস্থা ধ্বংস হওয়ায় উৎপাদন কমে যাওয়ার পাশাপাশি মাটির লবণাক্ততা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে কৃষি পুনরুদ্ধারকে আরও কঠিন করে তুলছে।
পরিবেশগত ক্ষতির ভয়াবহতার বিষয়ে জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি সতর্কবার্তা দিয়েছে। সংস্থাটি জানিয়েছে, মাটির দূষণ, মিঠা পানির স্তর দ্রুত কমে যাওয়া এবং ভূমির অতিমাত্রার ক্ষতি ভবিষ্যতে খাদ্য উৎপাদনের জন্য গুরুতর হুমকি হয়ে উঠতে পারে। মাটি ও পানির গুণগত মানের এই অবনতি জনস্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। বিশুদ্ধ পানির সংকট, কৃষিজমি হারানো এবং খাদ্যের ঘাটতি একত্রে গাজা উপত্যকার সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে।
অঞ্চলের চলমান মানবিক সংকট বিবেচনায় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো অনেক আগেই সতর্ক করেছিল যে, পুনর্গঠনের জন্য পর্যাপ্ত সহায়তা ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত না হলে গাজার সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো দীর্ঘমেয়াদে ভেঙে পড়বে। বর্তমান স্যাটেলাইট চিত্র ও মাঠপর্যায়ের মূল্যায়ন ইঙ্গিত দিচ্ছে, খাদ্যব্যবস্থা ও কৃষি খাত পুনরুদ্ধারের জন্য হয়তো বহু বছর সময় লাগবে। এর সঙ্গে সংঘাতের পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি, সীমিত প্রবেশাধিকার এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ঘাটতি পুনর্গঠন কার্যক্রমকে আরও কঠিন করে তুলছে।
সাম্প্রতিক মৃত্যুর ঘটনা এবং স্যাটেলাইট চিত্রে প্রকাশিত ব্যাপক ধ্বংস ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, যুদ্ধবিরতির পরও গাজার নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও মানবিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল হতে পারেনি। সীমান্তবর্তী এলাকায় উত্তেজনা অব্যাহত থাকায় বেসামরিক মানুষের জীবনের ঝুঁকি বাড়ছে এবং একই সঙ্গে অঞ্চলটির দীর্ঘমেয়াদি পুনর্গঠন কার্যক্রম অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।