জেলা প্রতিনিধি
রূপগঞ্জে মোবাইল ফোন ও অনলাইন গেম ‘ফ্রি ফায়ার’-এর আইডি কেনার টাকা জোগাড় করতে নিজ বাড়িতে ডাকাতির নাটক সাজানোর অভিযোগে তিন কিশোরকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। শুক্রবার রাতে অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে। শনিবার তাদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, গ্রেপ্তার কিশোররা হলো—রূপগঞ্জের কাঞ্চন এলাকায় বসবাসকারী আব্দুর রশিদের ছেলে ও অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী শাহরিয়ার, হানিফ মিয়ার ছেলে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী নাবিল এবং আলী হোসেনের ছেলে ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী শাহ আলম। তারা তিনজনই কাঞ্চন ভারত চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং একই এলাকার বাসিন্দা।
ঘটনার সূত্রপাত ঘটে শুক্রবার রাতে, যখন শাহ আলম একটি নতুন মোবাইল ফোন কেনে। পরিবারের সদস্যরা মোবাইলটির মূল্য ও টাকার উৎস সম্পর্কে জানতে চাইলে সে প্রথমে এড়িয়ে যায়। পরে স্থানীয়দের সন্দেহ হলে বিষয়টি নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। স্থানীয়রা তিন কিশোরকে আটক করে ঘটনার সম্পর্কে আরও জানার চেষ্টা করলে তারা ডাকাতির ঘটনায় নিজেদের সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করে। এসময় স্থানীয়দের সহযোগিতায় তাদের কাছ থেকে নগদ ২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা এবং দুই ভরি স্বর্ণালংকার উদ্ধার করা হয়, যেগুলো সম্প্রতি একটি বাড়িতে ডাকাতির অভিযোগে চুরি যাওয়ার কথা বলা হয়েছিল।
গ্রেপ্তার হওয়া এক কিশোরের বাবা জানান, তার ছেলে দীর্ঘদিন ধরে কয়েকজন অসাধু বন্ধুর সঙ্গে মেশার ফলে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। তিনি বলেন, ছেলে মোবাইল গেম খেলায় আসক্ত হয়ে পড়ে এবং নতুন মোবাইল ও গেমের আইডি কেনার জন্য অর্থের প্রয়োজন ছিল। সেই কারণেই তারা মিলে পরিবারের অজান্তে ডাকাতির নাটক সাজানোর পরিকল্পনা করে। তিনি ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে সন্তানের भविष्य নিয়ে উদ্বেগ জানান।
রূপগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ তরিকুল ইসলাম বলেন, গত ২৪ নভেম্বর দুপুরে রূপগঞ্জের কাঞ্চন এলাকায় একটি বাড়িতে ডাকাতির অভিযোগ আসে। অভিযোগে বলা হয়, বাড়িতে থাকা এক কিশোরকে হাত-পা বেঁধে মারধর করে আলমারি ভেঙে ১০ লাখ টাকা ও ১০ ভরি স্বর্ণালংকার লুট করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। এই ঘটনায় ওই কিশোরের বাবা বাদী হয়ে থানায় ডাকাতির মামলা দায়ের করেন। মামলাটি তদন্তের সময় পুলিশ বিভিন্ন দিক অনুসন্ধান করছিল।
ওসি তরিকুল ইসলাম জানান, গ্রেপ্তার তিন কিশোর জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে যে তারা পরিকল্পিতভাবে নিজেদের বাড়িতে ডাকাতির ঘটনা ঘটিয়েছে। তারা প্রথমে বাড়ির পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে কিভাবে ঘটনাটি সাজানো যায় সে বিষয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে। পরে নির্ধারিত দিনে এক কিশোরকে বেঁধে রেখে অন্যান্য মালামাল লুট হয়ে গেছে এমন ভান সৃষ্টি করে। এর উদ্দেশ্য ছিল চুরি করা অর্থ দিয়ে মোবাইল ফোন কেনা এবং জনপ্রিয় অনলাইন গেম ‘ফ্রি ফায়ার’-এর আইডি ক্রয় করা।
পুলিশ জানিয়েছে, কিশোরদের স্বীকারোক্তি ও উদ্ধার করা মালামাল পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর মামলার গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে। তদন্তকারী কর্মকর্তারা মনে করছেন, বিষয়টি কিশোর অপরাধের একটি উদ্বেগজনক দৃষ্টান্ত, যেখানে অনলাইন গেমে আসক্তির কারণে তারা বড় ধরনের অপরাধে জড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে কিশোরদের মধ্যে অনলাইন গেমের প্রতি অতি আসক্তি ক্রমেই বাড়ছে, যা অনেক ক্ষেত্রে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত করছে।
এ ঘটনার পর স্থানীয় অভিভাবকদের মধ্যে কিশোরদের নিরাপত্তা, তাদের সময় ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তি ব্যবহারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। এলাকাবাসী মনে করছেন, পরিবারে নজরদারি বাড়ানো হলে কিশোরদের এমন কর্মকাণ্ডে জড়ানো অনেকটাই কমে আসবে। একই সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি আসক্তি ও সাইবার সচেতনতা বিষয়ে শিক্ষামূলক কার্যক্রম জোরদারের দাবি উঠেছে।
রূপগঞ্জ থানা সূত্রে জানা গেছে, উদ্ধার হওয়া স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা পরবর্তী আইনি প্রক্রিয়া শেষে প্রকৃত মালিকের কাছে হস্তান্তর করা হবে। পাশাপাশি কিশোরদের অপরাধে প্ররোচনাকারী অন্য কেউ জড়িত আছে কি না—তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত পুলিশের অভিযানে আরও গ্রেপ্তারের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
ঘটনাটি এলাকায় ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, এই ঘটনা কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে অভিভাবক, বিদ্যালয় ও স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা আবারও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।