আন্তর্জাতিক ডেস্ক
ভারতের রিজার্ভ ব্যাংক (আরবিআই) শুক্রবার নীতিগত সুদের মূল হার বা রেপো রেট ২৫ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে ৫.২৫ শতাংশে নামিয়েছে এবং ব্যাংকিং খাতে প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ তারল্য যোগ করার ঘোষণা দিয়েছে। বৈশ্বিক ও আভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক চাপে নেওয়া এই সমন্বিত পদক্ষেপ ভারতের সামষ্টিক অর্থনীতিতে নতুন দিক নির্দেশনা তৈরি করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
নীতিগত সুদের হার কমানো এবং তারল্য বাড়ানোর সিদ্ধান্ত মূলত বিদেশি বাণিজ্য চাপ, মুদ্রার অবমূল্যায়ন এবং সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মুদ্রাস্ফীতির দ্রুত নিম্নগামী প্রবণতার প্রেক্ষাপটে নেওয়া হয়েছে। আরবিআইয়ের এই পরিবর্তন দেশের ঋণ বাজার, শিল্প খাত, ভোক্তা ব্যয় এবং সামগ্রিক বিনিয়োগ পরিবেশে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে।
ভারত বর্তমানে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি, তবে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নীতির কারণে দেশটি আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির চাপের মুখে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ নীতির ফলে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে, যা রুপির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। রুপির ধারাবাহিক অবমূল্যায়ন দেশের আমদানি ব্যয় আরও বাড়িয়ে তোলে এবং আরবিআইয়ের ওপর নীতিগত হস্তক্ষেপের চাপ সৃষ্টি করে। এই প্রেক্ষাপটে সুদের হার কমিয়ে অর্থনৈতিক কার্যক্রম সক্রিয় করার পাশাপাশি তারল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতকে আরও স্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত আরবিআই মোট ১২৫ বেসিস পয়েন্ট নীতিগত সুদের হার কমিয়েছে, যা ২০১৯ সালের পর সুদের হারে সবচেয়ে বড় শিথিলতা। এতে ঋণ গ্রহণ সস্তা হবে, শিল্প-উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ বাড়তে পারে এবং ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে পারে। আরবিআই গভর্নর সঞ্জয় মালহোত্রা জানান, ভারতের অর্থনীতি বর্তমানে একটি “বিরল গোল্ডিলকস” পরিস্থিতিতে অবস্থান করছে—অর্থাৎ মুদ্রাস্ফীতি কম, প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীল এবং সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে ইতিবাচক প্রবণতা রয়েছে।
অক্টোবর থেকে ভারতের খুচরা মুদ্রাস্ফীতি দ্রুত হ্রাস পেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত নিম্নতম সহনশীলতার সীমারও নিচে নেমে গেছে। অক্টোবরে খুচরা মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল মাত্র ০.২৫ শতাংশ, যা দেশটির ইতিহাসে সর্বনিম্ন। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকার কারণেই আরবিআই সুদের হারে শিথিলতার সুযোগ পাচ্ছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সতর্ক থেকেছে যাতে অতিরিক্ত তারল্য বা সুদের তীব্র হ্রাস অর্থনীতিতে অপ্রত্যাশিত ঝুঁকি তৈরি না করে।
সামষ্টিক অর্থনীতির চিত্র আরও ইতিবাচক হয়েছে প্রবৃদ্ধির নতুন পূর্বাভাসে। আরবিআই চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ৬.৮ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭.৩ শতাংশ করেছে, যা শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ চাহিদা, স্থিতিশীল বিনিয়োগ প্রবাহ এবং সেবা ও উৎপাদন খাতের সম্প্রসারণকে প্রতিফলিত করে। একই সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতির পূর্বাভাস ২.৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ করা হয়েছে। নিম্ন মুদ্রাস্ফীতি ও শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি একসঙ্গে থাকা সাধারণত অর্থনীতির স্বাস্থ্যগত স্থিতিশীলতার ইঙ্গিত বহন করে।
বৈদেশিক খাত সম্পর্কেও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন আরবিআই গভর্নর। তিনি বলেন, ভারতের বৈদেশিক ক্ষেত্র এখনও স্থিতিস্থাপক রয়েছে এবং বৈদেশিক অর্থায়নের চাহিদা “আরামদায়কভাবে” পূরণ করা যাবে। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বর্তমানে তুলনামূলক স্থিতিশীল পর্যায়ে রয়েছে, যা আমদানি ব্যয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের ঝুঁকি মোকাবিলায় সহায়ক।
বিশ্লেষকদের মতে, সুদের হার কমানো ও তারল্য বৃদ্ধি ভারতের অর্থনীতি স্বল্পমেয়াদে স্বস্তি এনে দেবে। ঋণের খরচ কমে গেলে ব্যবসায়ে বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং ভোক্তা ব্যয়সহ বিভিন্ন খাতে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। ব্যাংকিং খাতেও ঋণ আদায়ের সক্ষমতা উন্নত হতে পারে, কারণ নিম্ন সুদের পরিবেশে খেলাপি ঋণের ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কমে আসে।
তবে ভবিষ্যতে বৈশ্বিক অর্থনীতি, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের আর্থিক নীতি ভারতের সামষ্টিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য ওঠানামা, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা এবং বৈশ্বিক বাণিজ্য নীতির পরিবর্তন ভারতের আমদানি ব্যয় ও মুদ্রাবাজারে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করতে পারে। এসব কারণে আরবিআইকে আগামী মাসগুলোতে সতর্কতার সঙ্গে নীতি পরিচালনা করতে হতে পারে বলে ধারণা করছেন অর্থনীতিবিদরা।
আরবিআইয়ের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত ভারতীয় অর্থনীতিকে স্বল্পমেয়াদে প্রবৃদ্ধির আরও বৃহত্তর পরিসর দিতে পারে। তবে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক বাণিজ্য ভারসাম্য এবং বৈশ্বিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা—এই তিনটি বিষয়ই আগামী সময়ে ভারতের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার কেন্দ্রে থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে।