চলতি বছরের নভেম্বরে পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৮ দশমিক ২৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা অক্টোবরে ছিল ৮ দশমিক ১৭ শতাংশ। সাধারণত শীতের শুরুতে সবজিসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্যের সরবরাহ বাড়ায় খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতি কমার প্রবণতা দেখা যায়। তবে এবার সেই মৌসুমেও বিপরীত চিত্র দেখা গেছে। রবিবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
নভেম্বরের প্রতিবেদনে দেখা যায়, খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি আগের মাসের তুলনায় সামান্য বৃদ্ধি পেয়ে ৭ দশমিক ৩৬ শতাংশে পৌঁছেছে। অক্টোবরে এই হার ছিল ৭ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। অর্থনীতিবিদদের মতে, খাদ্যপণ্যের কিছু উপখাতে সরবরাহগত ব্যয় বৃদ্ধি, পরিবহন খরচ, এবং বাজারে দাম স্থিতিশীল না থাকার কারণে মৌসুমে প্রত্যাশিত স্বস্তি পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় নিম্ন ও মধ্যম আয়ের পরিবারগুলোতে ব্যয়চাপ আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
তবে সামগ্রিক চিত্র বিবেচনায় দেখা যায়, গত বছরের তুলনায় মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ, যা বর্তমান বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। একইভাবে খাদ্যপণ্যে গত বছরের নভেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ, যা এ বছরের তুলনায় প্রায় অর্ধেক কম। দীর্ঘমেয়াদে মূল্যস্ফীতির এই ধীরগতির নিম্নমুখী প্রবণতা নীতিনির্ধারকদের জন্য ইতিবাচক হলেও স্বল্পমেয়াদে বৃদ্ধি পাওয়া মাসওয়ারি হার বাজার পরিস্থিতির অস্থিতিশীলতা নির্দেশ করে।
খাদ্যবহির্ভূত বা নন-ফুড খাতে নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। এ খাতে মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ, যা অক্টোবরে ছিল ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ। তুলনামূলকভাবে নন-ফুড খাতে মূল্যস্ফীতি ইতিবাচক দিকেই রয়েছে, কারণ এর আগের বছর নভেম্বরে এই হার ছিল ৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ। অর্থনীতিবিদদের মতে, নন-ফুড পণ্যে সামান্য স্থিতিশীলতা দেখা গেলেও সামগ্রিক পরিবারের ব্যয়চাপ এখনও উচ্চমাত্রায় রয়েছে। আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও পোশাক খাতে ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমেনি, ফলে নন-ফুড খাতে সামান্য মূল্যস্ফীতির পতন সত্ত্বেও ভোক্তার দৈনন্দিন ব্যয় অনেকটাই অপরিবর্তিত।
বিশ্লেষকদের মতে, কৃষিপণ্যের উৎপাদন, আমদানি ব্যয়, এবং বিতরণ পর্যায়ের ব্যয়বৃদ্ধি খাদ্যদ্রব্যের দামে প্রভাব ফেলছে। দেশীয় উৎপাদন বেড়েছে ঠিকই, তবে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য, ডলারের বিনিময় হার, জ্বালানির দাম ও পরিবহন ব্যয় মূল্যস্ফীতিতে দীর্ঘমেয়াদি চাপ সৃষ্টি করছে। এ ছাড়া বাজার ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি ও সরবরাহে অসামঞ্জস্য থাকায় মৌসুমি শাকসবজিতেও মূল্যস্ফীতি কমার প্রবণতা সুস্পষ্ট হয়নি।
বিবিএসের প্রতিবেদনে অঞ্চলভিত্তিক মূল্যস্ফীতির চিত্রও উল্লেখ করা হয়। গ্রামীণ ও শহুরে উভয় অঞ্চলে মূল্যস্ফীতির চাপ অব্যাহত থাকলেও শহরাঞ্চলে নন-ফুড খাতে ব্যয় বেশি হওয়ায় তুলনামূলকভাবে উচ্চ হারে মূল্যস্ফীতি দেখা যায়। অন্যদিকে গ্রামীণ অঞ্চলে খাদ্যখাতেই ব্যয়চাপ বেশি, ফলে খাদ্যপণ্যের সামান্য বৃদ্ধিও পরিবারের সার্বিক খরচ বাড়িয়ে দেয়।
জাতীয় অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির বর্তমান প্রবণতা নীতিনির্ধারকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়ে থাকে। সাময়িকভাবে মূল্যস্ফীতি বাড়ার এই প্রবণতা মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির কার্যকারিতা পুনর্বিবেচনার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে। নীতিনির্ধারকদের অনেকেই মনে করেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজার তদারকি জোরদার করা, সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নত করা এবং আমদানি ব্যয় কমাতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে কৃষিপণ্যের উৎপাদন ও সংরক্ষণ ব্যবস্থার উন্নয়নও দীর্ঘমেয়াদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
নভেম্বরের প্রতিবেদন তাই স্বল্পমেয়াদে বাজারের অস্থিরতা এবং দীর্ঘমেয়াদে নিয়ন্ত্রণের সুযোগ—উভয় দিকই তুলে ধরে। সামগ্রিকভাবে মূল্যস্ফীতি এখনও উচ্চমাত্রায় থাকায় আগামী মাসগুলোতে পরিস্থিতি কোন দিকে যায়, তা নীতিনির্ধারক ও সাধারণ ভোকাদের জন্য সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।