আন্তর্জাতিক ডেস্ক
সুদানের পূর্বাঞ্চলে একটি সামরিক পরিবহন বিমান অবতরণের সময় বিধ্বস্ত হয়ে ক্রুসদস্যদের সবাই নিহত হয়েছেন। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার লোহিত সাগর উপকূলবর্তী অঞ্চলের ওসমান দিগনা বিমানঘাঁটিতে এ দুর্ঘটনা ঘটে। সামরিক বাহিনীর দুটি পৃথক সূত্র নিশ্চিত করেছে যে, অবতরণের চেষ্টাকালে কারিগরি ত্রুটির কারণে বিমানটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে যায় এবং এতে কেউ জীবিত থাকতে পারেননি।
সামরিক সূত্র জানায়, দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হওয়া বিমানটি ছিল ইলিউশিন ইল-৭৬ মডেলের একটি কার্গো পরিবহন বিমান, যা দীর্ঘদিন ধরে সুদানে বিভিন্ন সরঞ্জাম ও কর্মী পরিবহনে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বিমানটি নিয়মিত লজিস্টিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ওসমান দিগনা বিমানঘাঁটিতে অবতরণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ঠিক সেই সময় হঠাৎ যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে পাইলটরা জরুরি অবতরণের চেষ্টা করেন। তবে প্রচেষ্টাটি ব্যর্থ হয় এবং বিমানটি রানওয়ের কাছাকাছি এলাকায় বিধ্বস্ত হয়ে অগ্নিদগ্ধ হয়।
ঘটনার পরপরই সামরিক উদ্ধারকারী দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে এবং ধ্বংসাবশেষে অনুসন্ধান চালায়। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি বিমানে কতজন ক্রুসদস্য ছিলেন। সেনাবাহিনী এখনো হতাহতের সরকারি পরিসংখ্যান প্রকাশ করেনি। সামরিক সূত্রের বরাত অনুযায়ী, বিমানে থাকা সব সদস্য ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান।
সুদানের সামরিক পরিবহন ব্যবস্থায় ইলিউশিন ইল-৭৬ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জাম, মানবিক সহায়তা, চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং কর্মী পরিবহনের ক্ষেত্রে এই বিমানটি বহু বছর ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বিশেষত লোহিত সাগর উপকূলবর্তী অঞ্চলে অবস্থানরত সেনাবাহিনী এবং প্রশাসনিক ইউনিটগুলোর সহায়তার ক্ষেত্রে এ ধরনের পরিবহন বিমানের ওপর নির্ভরতা তুলনামূলক বেশি। ফলে এই দুর্ঘটনা শুধু হতাহতের দিক থেকেই নয়, সামরিক লজিস্টিক ব্যবস্থার ওপরও তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ঘটনাটি এমন এক সময় ঘটল যখন সুদান বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ মানবিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে দেশটির সেনাবাহিনী এবং আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)-এর মধ্যে সৃষ্ট ক্ষমতার দ্বন্দ্ব রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নিয়েছে। দেশব্যাপী বিস্তৃত এই সংঘাতে এখন পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, যা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে।
সংঘাতের কারণে সুদানের বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্য, ওষুধ এবং নিরাপদ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। লড়াই অব্যাহত থাকার ফলে মানবিক সহায়তা পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেক এলাকায় পরিবহন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে এবং বেসামরিক জনগণের চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দেশটির লোহিত সাগর উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলো সংঘাতের চাপ তুলনামূলক কম হলেও, সেখানে সামরিক উপস্থিতি ও তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সামরিক পরিবহন বিমানের কার্যক্রম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, কারণ এসব বিমান মানবিক ও সামরিক সরঞ্জাম পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বিকল্প উপায় হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
দুর্ঘটনার ফলে চলমান মানবিক সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রেও কিছু প্রভাব পড়তে পারে। সামরিক পরিবহন ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটলে সংঘাতপ্রবণ ও দুর্গম এলাকাগুলোতে সহায়তা পৌঁছানো আরও কঠিন হয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে যেসব এলাকায় স্থলপথে যাতায়াত সীমিত কিংবা বিপজ্জনক, সেখানে বিমান পরিবহনের গুরুত্ব অপরিসীম।
সুদানের বর্তমান রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিবেচনায় দুর্ঘটনার তদন্তকে কেন্দ্র করে নতুন প্রশ্নও উঠতে পারে। সামরিক সূত্র বলছে, দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে প্রাথমিকভাবে কারিগরি ত্রুটিকেই দায়িত্বশীল ধরা হলেও এটি ছিল কি না পুরোনো বিমান বা রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থার ঘাটতির ফল, তা এখনো স্পষ্ট নয়। সংঘাতময় পরিস্থিতিতে সামরিক অবকাঠামোর ওপর চাপ বেড়েছে, যা পরিবহন ব্যবস্থার সক্ষমতাকেও প্রভাবিত করতে পারে।
তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সামরিক বাহিনী বিস্তারিত কোনো তথ্য প্রকাশ করবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সুদানের মতো সংকটাপন্ন দেশে সামরিক পরিবহন ব্যবস্থার যে ভূমিকা রয়েছে, এই দুর্ঘটনা সেই কাঠামোর নিরাপত্তা, সক্ষমতা ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রক্রিয়া নিয়ে নতুন আলোচনা উত্থাপন করবে।