আন্তর্জাতিক ডেস্ক
গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় রাফাহ এলাকায় ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে অন্তত দুইজন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। বুধবার রাফাহ সীমান্ত অঞ্চলের উপকণ্ঠে এই ঘটনা ঘটে বলে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার পর্যবেক্ষক ও স্থানীয় প্রশাসনিক সূত্রে জানা গেছে। সামরিক অভিযানের ধারাবাহিকতার মধ্যে এই ঘটনায় পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে পড়েছে বলে স্থানীয় জরুরি কর্মীরা জানিয়েছেন।
গাজায় চলমান সংঘাতের মধ্যেই ইসরায়েলি স্থলবাহিনী এখন উপকূলীয় এই অঞ্চলের বড় একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর হিসাব অনুযায়ী, গাজার প্রায় ৫৮ শতাংশ এলাকা বর্তমানে ইসরায়েলের সামরিক নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, যার মধ্যে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ রাফাহ শহরও অন্তর্ভুক্ত। রাফাহ সীমান্তটি গাজার বাকি পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগের অন্যতম প্রধান পথ হওয়ায় এর সামরিক নিয়ন্ত্রণ দীর্ঘমেয়াদে মানবিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে বলে বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন।
বুধবারের ঘটনাটি ঘটে রাফাহ সীমান্তবর্তী উপকণ্ঠে। স্থানীয় জরুরি সেবা কর্মীদের তথ্য অনুযায়ী, ওই এলাকায় ইসরায়েলি সৈন্যদের গুলিতে দুইজন ফিলিস্তিনি নিহত হন। ঘটনাস্থল থেকে আহতদের সরিয়ে নেওয়ার কাজ সামান্য সময়ের জন্য ব্যাহত হয়, কারণ এলাকাটি দীর্ঘদিন ধরে সংঘাতের কারণে বিধ্বস্ত এবং পরিবহনব্যবস্থা বিপর্যস্ত। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, অভিযানের কারণে রাফাহ জুড়ে প্রচণ্ড উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে।
এদিকে দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসের আল-মাওয়াসি এলাকায় বাস্তুচ্যুত মানুষের অস্থায়ী তাবুগুলোও নতুন সংকটের মুখে পড়েছে। বুধবারের টানা ভারি বৃষ্টিতে ওই অঞ্চলের ডজনখানেক তাবু সম্পূর্ণ প্লাবিত হয়। বহু পরিবার তাবুর ভেতর পানিবন্দি হয়ে পড়ে, ফলে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও শুকনো পোশাকের সংকট আরও তীব্র হয়। স্থানীয় পরিবারগুলো জানায়, আশ্রয়কেন্দ্রের পরিবেশ এতটাই কর্দমাক্ত হয়ে পড়েছে যে শিশু, বৃদ্ধ এবং অসুস্থ ব্যক্তিদের তাত্ক্ষণিক সেবা দেওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে।
রাফাহের ফিলিস্তিনি সিভিল ডিফেন্স জানিয়েছে, দক্ষিণ গাজার সর্বত্র থেকে জরুরি সাহায্যের জন্য বিপুল সংখ্যক ফোনকল আসছে। অনেক পরিবার ভারি বৃষ্টির কারণে তাবুর ভিতর আটকা পড়ে আছে এবং সরে যাওয়ার মতো নিরাপদ স্থানেরও অভাব রয়েছে। জরুরি সেবা দলগুলো জানায়, তারা সীমিত সামর্থ্যে উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করছে; তবে বৃষ্টি, ধ্বংসস্তূপ ও সামরিক নিষেধাজ্ঞার কারণে কার্যক্রম জটিল হয়ে উঠেছে।
ইসরায়েলের ধারাবাহিক বোমাবর্ষণ ও স্থল অভিযান গাজার প্রায় পুরো জনসংখ্যাকেই বাস্তুচ্যুত করেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সর্বশেষ মূল্যায়নে দেখা যায়, এলাকার বাসিন্দারা এখনো পর্যাপ্ত খাদ্য, আশ্রয়, চিকিৎসা ও নিরাপত্তার ঘাটতির মুখোমুখি। ঘরবাড়ি, হাসপাতাল, স্কুল, রাস্তাঘাটসহ অবকাঠামোগুলো ব্যাপকভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, গাজাকে পুনর্গঠনে প্রায় ৭০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ব্যয় হতে পারে, এবং এই প্রক্রিয়া বহু বছর ধরে চলতে পারে।
দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে কার্যকর যুদ্ধবিরতির পরও ফিলিস্তিনিদের জন্য টেকসই অস্থায়ী আশ্রয় নির্মাণ শুরু হয়নি। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বারবার বলছে যে যুদ্ধবিরতির সুযোগ কাজে লাগিয়ে জরুরি মানবিক সহায়তা, চিকিৎসা সরঞ্জাম, নির্মাণসামগ্রী ও আশ্রয়সুবিধা দ্রুত বৃদ্ধি করা জরুরি। কিন্তু অব্যাহত সামরিক উত্তেজনা, পণ্য পরিবহনে সীমাবদ্ধতা এবং নিরাপদ করিডর না থাকায় কার্যকর পুনর্বাসন কার্যক্রম বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়েছে।
গাজার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সতর্ক করে বলছে, রাফাহ ও দক্ষিণ গাজায় সাম্প্রতিক বৃষ্টিপাত বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর জন্য নতুন মানবিক সংকট তৈরি করেছে। শীত মৌসুম ঘনিয়ে আসায় ঠান্ডা, পানি, দুর্বল কাঠামোর তাবু এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি মিলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের নিরাপত্তা আরও হুমকির মুখে পড়তে পারে।
স্থানীয় প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সামরিক অভিযান অব্যাহত থাকলে ও আশ্রয়কেন্দ্রে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি না থাকলে মানবিক পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাবে। তারা আন্তর্জাতিক সহায়তা দ্রুত বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে এবং বিশেষ করে রাফাহ ও খান ইউনিসে জরুরি ত্রাণ কার্যক্রম জোরদার করার তাগিদ দিয়েছেন।
গাজার চলমান সংকটের মধ্যে বুধবার রাফাহে দুই ফিলিস্তিনির মৃত্যুর ঘটনা পরিস্থিতির অবনতি আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। বৃষ্টি, বাস্তুচ্যুতি ও সামরিক উত্তেজনার মধ্যে দক্ষিণ গাজার মানবিক বিপর্যয় সামনের দিনগুলোতে আরও গভীর হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।