খেলাধুলা ডেস্ক
২০২৬ সালের ফুটবল বিশ্বকাপকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে আগে থেকে নির্ধারিত এলজিবিটিকিউ+ প্রাইড উদযাপন অনুষ্ঠানের সময়সূচি নিয়ে তীব্র আপত্তি জানিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দুই দেশ ইরান ও মিসর। বিশ্বকাপের সূচি ঘোষণার পর জানা যায়, ইরান ও মিসরের মধ্যকার গ্রুপপর্বের ম্যাচ যেদিন লুমেন ফিল্ডে অনুষ্ঠিত হবে, সেদিনই শহরজুড়ে প্রাইড সম্পর্কিত শোভাযাত্রা ও শিল্পকর্ম প্রদর্শনের পরিকল্পনা রয়েছে। এ বিষয়টি জানার পর দুই দেশের ফুটবল ফেডারেশন ফিফার কাছে আনুষ্ঠানিক আপত্তিপত্র পাঠিয়েছে।
গত ৫ ও ৬ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে ২০২৬ বিশ্বকাপের ড্র অনুষ্ঠিত হয়। এতে ‘জি’ গ্রুপে স্থান পায় বেলজিয়াম, মিসর, ইরান ও নিউজিল্যান্ড। সূচি অনুযায়ী গ্রুপের শেষ ম্যাচটি ২৭ জুন সিয়াটলের লুমেন ফিল্ডে ইরান ও মিসরের মধ্যে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। ড্রয়ের পরই দুই দেশ জানতে পারে, ওই সময় শহরে এলজিবিটিকিউ+ প্রাইড উদযাপনের অংশ হিসেবে স্টেডিয়ামসংলগ্ন এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে সাংস্কৃতিক আয়োজন, শিল্পকর্ম প্রদর্শনী ও জনসমাবেশের পরিকল্পনা রয়েছে। এতে সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রশ্নে দেশ দুটি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে।
২০০৭ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর সিয়াটলে প্রাইডফেস্ট আয়োজন করে স্থানীয় একটি অলাভজনক সংস্থা। বিশ্বকাপের সূচি ঘোষণার আগেই তারা জুনের শেষ সপ্তাহকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন কার্যক্রমের পরিকল্পনা সম্পন্ন করেছিল। যদিও ২৬ বা ২৭ জুন কোনো আন্তর্জাতিক দিবস নয়, তবে ২৮ জুন এলজিবিটিকিউ অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ায় কাছাকাছি তারিখে উদযাপন কার্যক্রম রাখার সিদ্ধান্ত নেয় আয়োজকেরা। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৬ জুন সিয়াটলের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ আয়োজন, শিল্পকর্ম প্রদর্শনী ও জনসমাবেশের প্রস্তুতি নেওয়া হয়, যা বাংলাদেশ সময় অনুযায়ী ২৭ জুন ইরান-মিসরের ম্যাচের দিন।
সিয়াটল লুমেন ফিল্ডে ২০২৬ বিশ্বকাপে মোট ছয়টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে—গ্রুপপর্বের চারটি এবং নকআউট পর্বের দুটি। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বিশেষভাবে ১৯ জুন ও ২৬ জুন দুটি ম্যাচকে কেন্দ্র করে শহরজুড়ে আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯ জুন যুক্তরাষ্ট্রে জুনটিনথ দিবস হিসেবে পালিত হয়, যা দাসপ্রথা বিলুপ্তির স্মরণে প্রতি বছর পালন করা হয় এবং এটি সরকারি ছুটির দিন। আর ২৬ জুনকে প্রাইড-সম্পর্কিত অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য নির্ধারণ করা হয়, যদিও ফিফার এসব সিদ্ধান্তের ওপর কোনো এখতিয়ার নেই; কারণ শহর ও স্টেডিয়ামসংলগ্ন এলাকার সাংস্কৃতিক কার্যক্রম স্থানীয় সরকারের অধীন।
ইরান ও মিসর স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, মাঠে তাদের দলের খেলার সময় এমন কোনো আয়োজন তারা মেনে নিতে প্রস্তুত নয় যা তাদের ধর্মীয় বিধান বা সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ইরান ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি মেহদি তাজ বলেন, নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর সমর্থনে এমন আয়োজন তাদের জন্য অগ্রহণযোগ্য এবং তারা এ বিষয়ে ফিফাকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে। একই সুরে মিসর সকার ফেডারেশনের প্রধান আদো রিদা জানান, এ ধরনের কর্মকাণ্ড তারা প্রত্যাখ্যান করছে; কারণ এটি তাদের সংস্কৃতি, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তিনি আরও বলেন, দুই দেশের দর্শকদের জন্য স্পর্শকাতর এমন আয়োজন মাঠের ভেতরে বা আশেপাশে না রাখার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
এরপরই সিয়াটলে প্রাইড উদযাপনের সমন্বয়কারী কমিটি জানায়, ম্যাচ চলাকালে স্টেডিয়ামের ভেতরে কোনো ধরনের প্রাইড কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হবে না। স্টেডিয়ামের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে ফিফার তত্ত্বাবধানে থাকে এবং আয়োজক সংস্থা সেসব ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করে না। কমিটির যোগাযোগ বিভাগের সহ-সভাপতি হানা তাদেসি জানান, পূর্ব পরিকল্পনার পরিবর্তন এনে স্টেডিয়ামের ভেতরের পরিবর্তে শহরের বিভিন্ন স্থানে এবং প্রাইড সপ্তাহজুড়ে উদযাপন চলবে।
লুমেন ফিল্ডের ধারণক্ষমতা প্রায় ৭২ হাজার। ইরান ও মিসরের বিপুলসংখ্যক সমর্থক যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করে বলে ধারণা করা হয়, ফলে ম্যাচটিতে উল্লেখযোগ্য দর্শকসমাগমের সম্ভাবনা রয়েছে। স্থানীয় বিশ্লেষকদের মতে, দুই দেশের সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা বিবেচনায় আয়োজকদের এই সিদ্ধান্ত সামগ্রিক নিরাপত্তা ও দর্শক-পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। পাশাপাশি এটি আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের এক উদাহরণ হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে।
এদিকে, ফিফা বিষয়টি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বলে জানিয়েছে বিভিন্ন সূত্র। বিশ্বকাপ চলাকালে সদস্য দেশগুলোর সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ সংরক্ষণ এবং আয়োজকদের স্বাধীন সিদ্ধান্তের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা সবসময়ই একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ঘটনা ভবিষ্যতে বৈশ্বিক ক্রীড়ায় সংস্কৃতিগত সংবেদনশীলতা ও স্থানীয় উদযাপন ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পারে।