আন্তর্জাতিক ডেস্ক
ফ্রান্সের বিশ্বখ্যাত ল্যুভ মিউজিয়ামে চুরির সাম্প্রতিক ঘটনায় নিরাপত্তা ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য ব্যর্থতা চিহ্নিত করেছে দেশটির সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, অপরাধীরা মাত্র ৩০ সেকেন্ডের সুযোগ কাজে লাগিয়ে জাদুঘরের কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেদ করতে সক্ষম হয় এবং মূল্যবান রত্ন চুরি করে পালিয়ে যায়।
গত ১৯ অক্টোবর চারজন অপরাধী অ্যাপোলো গ্যালারির একটি ভঙ্গুর কাচের জানালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে প্রায় ১০২ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের রত্ন ও একটি ঐতিহাসিক মুকুট লুট করে। ঘটনার পরপরই জাদুঘরের নিরাপত্তা প্রটোকল ও নজরদারি ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তদন্তে দেখা যায়, জাদুঘরের বাইরের এলাকায় পর্যাপ্ত ক্যামেরা স্থাপন করা হয়নি এবং যে ক্যামেরাগুলো ছিল, সেগুলোর সবগুলোকে একই সময়ে পর্যবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক মনিটর নিরাপত্তা কর্মীদের কাছে ছিল না। ফলে বাহ্যিক গতিবিধি পর্যবেক্ষণে সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় এবং অপরাধীরা সহজেই নিরাপত্তা ব্যবস্থার ফাঁকফোকর কাজে লাগাতে পারে।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয় যে, নিরাপত্তা কর্মীরা জাদুঘরের বিভিন্ন উইং পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত থাকায় অ্যাপোলো গ্যালারির জানালা ভাঙার ঘটনা তাৎক্ষণিকভাবে নজরে আসে না। জাদুঘরের বহির্বিভাগে ক্যামেরা কভারেজ কম থাকায় সন্দেহজনক কোনো গতিবিধিও আগেভাগে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, এমন একটি জাদুঘর যেখানে হাজারো মূল্যবান শিল্পকর্ম সংরক্ষিত থাকে, সেখানে ক্যামেরা নেটওয়ার্ক ও মনিটরিং সিস্টেম আরও উন্নত হওয়া প্রয়োজন।
ল্যুভ মিউজিয়ামে জরুরি ভিত্তিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। বিশেষ করে বাইরের ক্যামেরা সংখ্যা বৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ পর্যবেক্ষণ মনিটরের সক্ষমতা বাড়ানো, এবং জাদুঘরের জানালা ও প্রবেশপথের সুরক্ষা ব্যবস্থা আধুনিকায়নের বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তদুপরি, নিরাপত্তা কর্মীদের দক্ষতা ও সমন্বয় আরও শক্তিশালী করতে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালুর পরামর্শও দেওয়া হয়েছে।
চুরি যাওয়া মূল্যবান রত্ন ও মুকুট এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চোরাচালান হওয়া শিল্পকর্ম খুঁজে বের করতে ফ্রান্সের সংশ্লিষ্ট সংস্থা দেশ-বিদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছে। অতীতে শিল্পকর্ম চুরির বেশ কিছু ঘটনায় দেখা গেছে যে, চোরাচালানকারীরা দ্রুত এসব বস্তু দেশের বাইরে পাচার করার চেষ্টা করে। তাই তদন্ত দ্রুতগতিতে এগিয়ে নেওয়ার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে।
ল্যুভ মিউজিয়াম বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ও বিখ্যাত জাদুঘর, যেখানে প্রায় পাঁচ লাখ শিল্পকর্ম সংরক্ষিত আছে এবং এর মধ্যে ৩৮ হাজার প্রদর্শনী জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। প্রতিদিন এখানে প্রায় ৩০ হাজার দর্শনার্থী ভিড় করেন। জাদুঘরে কর্মরত আছেন প্রায় দুই হাজার ২০০ জন, যারা প্রদর্শনী, নিরাপত্তা, সংরক্ষণ ও দর্শনার্থী ব্যবস্থাপনা—এসব ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এত বৃহৎ পরিসরের একটি জাদুঘরে নিরাপত্তা বজায় রাখতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার অত্যাবশ্যক। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চুরি ও সাইবার হামলার মতো ঝুঁকি বাড়ার কারণে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী নজরদারি ব্যবস্থা সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে ল্যুভ কর্তৃপক্ষকে নতুন নিরাপত্তা নীতিমালা প্রণয়ন করতে হতে পারে, যা জাদুঘরের অভ্যন্তরীণ কাঠামো ও কর্মপদ্ধতিতেও পরিবর্তন আনতে পারে।
চুরির ঘটনায় ল্যুভ মিউজিয়ামের সুনাম ও দর্শনার্থীদের আস্থার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে বলে ধারণা করছেন পর্যবেক্ষকরা। যদিও জাদুঘর কর্তৃপক্ষ বিষয়টি মোকাবিলায় দ্রুত পদক্ষেপ নিচ্ছে, তবুও দীর্ঘমেয়াদে নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রসারে বাড়তি বিনিয়োগ প্রয়োজন হতে পারে। ভবিষ্যতে জাদুঘরটির নিরাপত্তা নীতি কতটা উন্নত হয় এবং চুরি যাওয়া রত্নগুলো উদ্ধার হয় কি না—সেটিই এখন আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।