আন্তর্জাতিক ডেস্ক
চীনা পেশাজীবীদের জন্য ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করার উদ্যোগ নিয়েছে ভারত সরকার। নয়াদিল্লি ও বেইজিংয়ের মধ্যকার কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক পুনরুজ্জীবনের ধারাবাহিকতায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট মহলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও ভারত সরকার এ বিষয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়নি, তবে সিদ্ধান্তটিকে ইতিবাচক হিসেবে স্বাগত জানিয়েছে চীন।
গত আগস্টে চীনের তিয়ানজিয়ান শহরে অনুষ্ঠিত সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলনের প্রেক্ষাপটে ভারত-চীন সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করে। ওই সম্মেলনের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মধ্যে একটি সাইডলাইন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় সাত বছর পর চীনের মাটিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিকে দুই দেশের সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে দেখা হয়। বৈঠকে সীমান্ত পরিস্থিতি, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয় বলে কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে।
এরপর ধীরে ধীরে দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ ও সহযোগিতা স্বাভাবিক হতে শুরু করে। পাঁচ বছর বন্ধ থাকার পর চলতি বছরের নভেম্বরে চীনা পর্যটকদের জন্য ভারতের টুরিস্ট ভিসা পুনরায় চালু করা হয়। পর্যটন ভিসা চালুর মাধ্যমে মানুষের পারস্পরিক যোগাযোগ বাড়ানোর উদ্যোগের পর এবার চীনা পেশাজীবীদের জন্য ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, নতুন ব্যবস্থায় চীনা পেশাজীবীরা আগের তুলনায় কম আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মধ্য দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ব্যবসা ও পেশাগত কাজে ভারতের ভিসা পাবেন।
নতুন ব্যবস্থার আওতায় চীনা পেশাজীবীদের জন্য বিজনেস ভিসা পাওয়ার সময়সীমা উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো হয়েছে। এখন থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সঠিক থাকলে চার সপ্তাহের মধ্যেই ভিসা ইস্যু করা হবে বলে জানা গেছে। এর ফলে প্রযুক্তি, উৎপাদন ও অবকাঠামোসহ বিভিন্ন খাতে কর্মরত চীনা বিশেষজ্ঞ ও প্রযুক্তিবিদদের ভারতে কাজ করা সহজ হবে।
ভারতের শিল্পখাতে বিশেষ করে ইলেকট্রনিকস ও প্রযুক্তি খাতে দক্ষ জনবলের ঘাটতি দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনায় রয়েছে। মোবাইল ফোন, সেমিকন্ডাক্টর এবং অন্যান্য ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত যন্ত্রাংশ ও কাঁচামালের বড় অংশ চীন থেকে আমদানি করা হয়। ভিসা জটিলতার কারণে প্রয়োজনীয় চীনা প্রযুক্তিবিদরা সময়মতো ভারতে আসতে না পারায় উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে বলে শিল্পসংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করে আসছিলেন। এ অবস্থায় ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করার সিদ্ধান্তকে অর্থনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে এ সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা দেয়নি। তবে কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সীমান্ত উত্তেজনা ও রাজনৈতিক মতপার্থক্য সত্ত্বেও অর্থনৈতিক স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে সম্পর্কের বাস্তবধর্মী পুনর্গঠনের পথে হাঁটছে নয়াদিল্লি। ভিসা সহজীকরণ দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা, বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি সহযোগিতা বাড়াতে সহায়ক হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
এদিকে ভারতের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে চীন। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গুও জিয়াকুন এক বিবৃতিতে বলেন, ভারত ও চীনের মধ্যে যোগাযোগ ও বিনিময় অব্যাহত রাখা জরুরি। তাঁর মতে, ভিসা প্রক্রিয়া সহজ হলে দুই দেশের মধ্যে পেশাগত ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ আরও জোরদার হবে এবং বিনিয়োগ সহযোগিতার ক্ষেত্রও সম্প্রসারিত হবে। তিনি আরও বলেন, পারস্পরিক আস্থা ও সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য এ ধরনের ইতিবাচক পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
গবেষণা সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, গত চার বছরে কঠোর ভিসা বিধিনিষেধের কারণে ভারতের ইলেকট্রনিকস খাতে উল্লেখযোগ্য আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। চীনা প্রযুক্তিবিদদের অনুপস্থিতির কারণে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি এবং সরবরাহ শৃঙ্খলে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। ভিসা প্রক্রিয়া সহজ হলে এ খাতে বিনিয়োগ বাড়ার পাশাপাশি উৎপাদন সক্ষমতা ও প্রযুক্তি স্থানান্তরেও ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
সামগ্রিকভাবে চীনা পেশাজীবীদের জন্য ভিসা সহজীকরণের উদ্যোগকে ভারত-চীন সম্পর্কের নতুন অধ্যায় হিসেবে দেখা হচ্ছে। রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্যেও অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও পারস্পরিক স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়ে দুই দেশ এগোতে চাইছে—এ সিদ্ধান্ত তারই একটি ইঙ্গিত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট মহল।