রাশিদুল হাসান বুলবুল, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের ঠিক আগে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠীগুলো শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, চিকিৎসক ও সংস্কৃতিকর্মীদের লক্ষ্য করে অপহরণ ও হত্যার মাধ্যমে নবজাত রাষ্ট্র বাংলাদেশের মেধাভিত্তিক ভিত্তিকে ধ্বংস করার উদ্যোগ নেয়। এই দিনটি পরবর্তীকালে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে জাতীয় ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে আছে।
ঢাকায় ওই দিন শিক্ষাবিদ ও নাট্যকার মুনীর চৌধুরীকে তাঁর বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরিবারের সদস্যদের সামনে তাঁকে বের করে নেওয়ার পর আর ফিরে আসেননি তিনি। একই দিনে বিজ্ঞানী মো. আমিনউদ্দিন, যিনি বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের ঊর্ধ্বতন গবেষণা কর্মকর্তা ছিলেন, তাঁকেও বাসা থেকে চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়। সাংবাদিক নিজামুদ্দীন আহমদকেও সন্তানদের সামনে থেকে অপহরণ করা হয়। তাঁদের মতো আরও বহু বুদ্ধিজীবীর শেষ সময়ের স্মৃতি স্বজনদের লেখায় সংরক্ষিত রয়েছে, যা মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিনগুলোর ভয়াবহ বাস্তবতা তুলে ধরে।
বিজয়ের পরপরই বুদ্ধিজীবীদের গণকবর আবিষ্কৃত হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ঢাকায় অবস্থানরত এক বিদেশি সাংবাদিকের দিনলিপিতে উল্লেখ পাওয়া যায়, ১৮ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী বিখ্যাত বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের গণকবরের সন্ধান পায়, যাঁদের আগের রাতে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। এসব তথ্য থেকে স্পষ্ট হয় যে, বুদ্ধিজীবীদের জিম্মি করে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছিল এবং এটি কোনো তাৎক্ষণিক সামরিক সিদ্ধান্তের ফল ছিল না।
মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাসজুড়েই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনা ঘটে। পিরোজপুরে ম্যাজিস্ট্রেট ও ট্রেজারি কর্মকর্তা সাঈফ মীজানুর রহমানকে প্রকাশ্যে নির্যাতনের পর হত্যা করে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ করেছিলেন। সিলেটে চা-বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপক সৈয়দ সিরাজুল আব্দালকে হত্যা করা হয়; পরে তাঁর পরিবারের কাছে দেহাবশেষ হস্তান্তর করা হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মীর আবদুল কাইয়্যুমকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যাওয়ার পর আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে নথিভুক্ত হয়েছে, যা প্রমাণ করে যে বুদ্ধিজীবী নিধন ছিল দেশব্যাপী পরিচালিত একটি কর্মসূচি।
গবেষণা ও সংকলনভিত্তিক প্রকাশনায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিচিতি ও মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের অবদানের বিবরণ পাওয়া যায়। এসব তথ্য অনুযায়ী, শিক্ষকতা, গবেষণা, প্রশাসন, সাহিত্য, সাংবাদিকতা ও চিকিৎসাসহ নানা পেশার মানুষ এই হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পাশাপাশি আলবদর বাহিনীসহ স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী এই হত্যাযজ্ঞে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এ পর্যন্ত চার দফায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নামের গেজেট প্রকাশ করেছে। এসব তালিকায় মোট ৫৬০ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। প্রথম দফায় ১৯১ জন, দ্বিতীয় দফায় ১৪৩ জন, তৃতীয় দফায় ১০৮ জন এবং চতুর্থ দফায় ১১৮ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম প্রকাশ করা হয়। গবেষকদের মতে, প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। তালিকাভুক্ত নামগুলোর অধিকাংশই শহরকেন্দ্রিক হওয়ায় গ্রামীণ ও প্রান্তিক অঞ্চলের অনেক শহীদের নাম এখনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির বাইরে রয়ে গেছে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের সময় দেওয়া সাক্ষ্য ও নথিপত্রে জানা যায়, ১৯৭১ সালের আগস্ট মাস থেকেই মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পরিকল্পনা করা হয় এবং ডিসেম্বরে তা বাস্তবায়ন শুরু হয়। স্বাধীনতার পর উদ্ধার হওয়া কিছু নথিতে নিহত ও জীবিত বুদ্ধিজীবীদের নামের তালিকার উল্লেখ পাওয়া গেছে, যা এই হত্যাকাণ্ডের পূর্বপরিকল্পিত চরিত্রকে আরও স্পষ্ট করে।
শহীদ বুদ্ধিজীবীরা স্বাধীন বাংলাদেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও মানবিক মূল্যবোধের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁদের সাহিত্যকর্ম, গবেষণা ও সাংস্কৃতিক অবদান আজও রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গভীর বেদনাদায়ক অধ্যায়, যা জাতির মেধাগত ক্ষতির প্রতীক হয়ে রয়েছে।
তথ্যসূত্র
স্মৃতি: ১৯৭১ (প্রথম খণ্ড), বাংলা একাডেমি প্রকাশনা
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী: স্মৃতি জীবন যুদ্ধ, সংকলন গ্রন্থ
মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ তারিখ ও দলিলভিত্তিক গবেষণা গ্রন্থ
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারসংক্রান্ত সাক্ষ্য ও সরকারি গেজেট