জাতীয় ডেস্ক
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে রবিবার ভোর থেকেই রাজধানীর মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ভিড় করেন বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ। রাষ্ট্রপতি, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা, রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, পেশাজীবী সংগঠন এবং সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে স্মৃতিসৌধ এলাকায় গাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
সকাল ৭টার দিকে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন প্রথমে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তিনি স্মৃতিসৌধের বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের পর কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে ১৯৭১ সালে নিহত বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতির প্রতি গভীর সম্মান জানান। এ সময় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
রাষ্ট্রপতির শ্রদ্ধা নিবেদনের কিছুক্ষণ পর সকাল সোয়া ৭টার দিকে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ সময় সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল রাষ্ট্রীয় সালাম প্রদান করে। শ্রদ্ধা নিবেদন অনুষ্ঠানে বীর মুক্তিযোদ্ধা, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা, সামরিক ও বেসামরিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। প্রধান উপদেষ্টার শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে পর্যায়ক্রমে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরাও পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে অন্তর্বর্তী সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে জনগণের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন বাংলাদেশ নির্মিত হবে। তিনি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগ স্মরণ করে বলেন, তাঁদের আদর্শ ও অবদান ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রগঠনে পথনির্দেশক হয়ে থাকবে।
রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে একে একে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, আইনজীবী, প্রকৌশলীসহ নানা পেশাজীবী সংগঠন এবং সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ। সকাল বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে মানুষের উপস্থিতি বাড়তে থাকে এবং পুরো এলাকা শোক ও শ্রদ্ধার আবহে পরিণত হয়।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গভীর বেদনার দিন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাত্র দুই দিন আগে ১৪ ডিসেম্বর রাতে পরিকল্পিতভাবে দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়। সে রাতে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ঘাতকচক্র শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিল্পী-সাহিত্যিক, সংস্কৃতিসেবী এবং সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের বাড়ি থেকে চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে যায়। সান্ধ্য আইন জারি থাকা অবস্থায় তালিকা অনুযায়ী পরিচালিত এই অভিযানে বুদ্ধিজীবীদের অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
পরদিন সকালে ঢাকার মিরপুর ও রায়েরবাজার এলাকার ডোবা-নালা ও ইটখোলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায় অসংখ্য নিথর দেহ। অনেকের শরীরে গুলির চিহ্ন ছিল, অনেককে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ও অমানুষিক নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছিল। হাত পেছনে বাঁধা অবস্থায় পড়ে থাকা এসব মরদেহ জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতির প্রতীক হয়ে ওঠে। স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে জাতিকে মেধাশূন্য করার উদ্দেশ্যেই এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল বলে ইতিহাসবিদরা উল্লেখ করে থাকেন।
প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালিত হয়। এ উপলক্ষে দেশের সর্বত্র জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয় এবং সরকারি-বেসরকারি ভবনে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন আলোচনা সভা, স্মরণসভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগ স্মরণ করে তাঁদের আদর্শ ও অবদান নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরাই এ দিনের মূল লক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।