জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
সম্পূর্ণ সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান থাকলেও বিচার বিভাগ এখনো পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেনি বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। তিনি বলেন, সাংবিধানিক কাঠামো ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় বিচার বিভাগের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো থাকলেও বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্রে স্বাধীনতার ঘাটতি রয়ে গেছে।
রোববার (১৪ ডিসেম্বর) সুপ্রিম কোর্ট অডিটোরিয়ামে দেশের জেলা আদালতে কর্মরত উচ্চপর্যায়ের বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের উদ্দেশে দেওয়া সমাপনী ও বিদায়ী অভিভাষণে তিনি এ মন্তব্য করেন। আগামী ২৭ ডিসেম্বর অবসরে যাওয়ার আগে এটি ছিল বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতির সর্বশেষ আনুষ্ঠানিক বক্তব্য।
প্রধান বিচারপতি তার বক্তব্যে বলেন, বিচার বিভাগের কার্যকর স্বাধীনতা শুধু আইন ও কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না; এর বাস্তব প্রতিফলন প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত, বাজেট ব্যবস্থাপনা এবং বিচারিক কর্মকাণ্ডের দৈনন্দিন প্রয়োগে নিশ্চিত করতে হবে। তিনি উল্লেখ করেন, বিচার বিভাগকে শক্তিশালী করতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রতি সব পক্ষের আন্তরিকতা প্রয়োজন।
বক্তব্যে তিনি জেলা পর্যায়ের বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের ভূমিকার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, তৃণমূল পর্যায়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার মাধ্যমে বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের আস্থা গড়ে ওঠে। সে জন্য বিচারকদের পেশাগত সততা, দক্ষতা ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আরও বলেন, বিচারিক স্বাধীনতা রক্ষায় বিচারকদের ব্যক্তিগত সাহস ও দায়িত্বশীল ভূমিকা অপরিহার্য।
ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ স্মরণ করিয়ে দেন, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে দেশের ২৫তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। একই বছরের ১১ আগস্ট তিনি প্রধান বিচারপতির শপথ নেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতা, দক্ষতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়ার কথা উল্লেখ করেন তিনি।
বিচার বিভাগীয় সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে প্রধান বিচারপতি বলেন, সময়োপযোগী আইন সংস্কার, মামলার জট কমানো এবং প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়াকে আরও গতিশীল করা সম্ভব। তিনি জেলা আদালত থেকে শুরু করে উচ্চ আদালত পর্যন্ত সমন্বিতভাবে কাজ করার ওপর গুরুত্ব দেন।
ব্যক্তিগত জীবন ও পেশাগত অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গ টেনে প্রধান বিচারপতি বলেন, শিক্ষা ও পেশাগত জীবনের বিভিন্ন পর্যায় তাকে আইন ও ন্যায়বিচার সম্পর্কে বিস্তৃত দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াডাম কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণিতে আইন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের টাফ্টস ইউনিভার্সিটির ফ্লেচার স্কুল অব ল অ্যান্ড ডিপ্লোমেসি থেকে মাস্টার্স ও পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।
তিনি অভিবাসন আইন বিশেষজ্ঞ হিসেবে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের সঙ্গে কাজ করেছেন। বিচারাঙ্গনে তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার শুরু ১৯৮৪ সালে ঢাকা জেলা আদালতে আইনজীবী হিসেবে। ১৯৮৬ সালে তিনি হাইকোর্ট বিভাগের আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। ২০০৩ সালের ২৭ এপ্রিল তিনি হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান এবং দুই বছর পর স্থায়ী বিচারপতি হন।
ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ প্রথিতযশা আইনজীবী ও সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমেদ এবং ভাষা সৈনিক ও একুশে পদকপ্রাপ্ত ড. সুফিয়া আহমেদের সন্তান। তার পরিবারিক পটভূমি ও দীর্ঘ পেশাগত অভিজ্ঞতা বিচার বিভাগের নেতৃত্বে তাকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সহায়তা করেছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
সমাপনী বক্তব্যে প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান। একই সঙ্গে তিনি ভবিষ্যতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও কার্যকারিতা আরও সুদৃঢ় হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।