জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
চব্বিশের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে দেওয়া আমৃত্যু কারাদণ্ডের সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড চেয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আপিল বিভাগে আবেদন করেছে প্রসিকিউশন। সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম সাংবাদিকদের এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
প্রসিকিউশন জানায়, ট্রাইব্যুনালের রায়ে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে একাধিক অপরাধে পৃথক পৃথক সাজা ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে একটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড এবং অন্য একটি অভিযোগে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়। প্রসিকিউশনের মতে, অপরাধের প্রকৃতি, ব্যাপকতা ও প্রভাব বিবেচনায় আমৃত্যু কারাদণ্ড অপর্যাপ্ত। এ কারণে ওই সাজার পরিবর্তে মৃত্যুদণ্ড চেয়ে আপিলে মোট আটটি আইনি যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছে।
এর আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ চব্বিশের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে মৃত্যুদণ্ড দেন। একই মামলায় রাজসাক্ষী হিসেবে বিবেচিত সাবেক পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল গত ১৭ নভেম্বর রায় ঘোষণা করেন।
রায়ে দণ্ডাদেশের পাশাপাশি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে গণঅভ্যুত্থানে নিহত ব্যক্তিদের পরিবার এবং আহতদের জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল রায়ে উল্লেখ করে যে, এসব অপরাধ শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা রাষ্ট্র ও সমাজের মৌলিক কাঠামোর ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে।
মামলার বিচার কার্যক্রমে প্রসিকিউশন পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলামসহ একাধিক প্রসিকিউটর অংশ নেন। রাষ্ট্রপক্ষের অন্যান্য আইন কর্মকর্তারাও শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন। পলাতক আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী শুনানিতে অংশ নেন এবং রাজসাক্ষীর পক্ষে পৃথক আইনজীবী যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা হিসেবে অ্যাটর্নি জেনারেলও আদালতে বক্তব্য দেন।
এই মামলায় মোট ৫৪ জন সাক্ষ্য দেন। সাক্ষীদের মধ্যে গণঅভ্যুত্থানে নিহত প্রথম ব্যক্তির পরিবারের সদস্য, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও নাগরিক আন্দোলনের প্রতিনিধি এবং ঘটনার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাক্ষীরা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তাঁদের সাক্ষ্যে গণঅভ্যুত্থান দমনে রাষ্ট্রীয় শক্তি, রাজনৈতিক সংগঠনের ক্যাডার এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশের সমন্বিত ভূমিকার বর্ণনা উঠে আসে।
মামলার অভিযোগ গঠন করা হয় ২০২৫ সালের ১০ জুলাই। বিচার চলাকালে একপর্যায়ে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন আদালতে দোষ স্বীকার করেন এবং ঘটনার প্রকৃত তথ্য উদঘাটনে রাজসাক্ষী হিসেবে সম্মতি দেন। তাঁর বক্তব্য ও সরবরাহ করা তথ্য মামলার প্রমাণ উপস্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বলে প্রসিকিউশন দাবি করে।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থান দমনের সময় সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একের পর এক মামলা দায়ের করা হয়। বর্তমানে দুটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এসব অভিযোগের বিচার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, এসব মামলার রায় ও আপিল কার্যক্রম ভবিষ্যতে বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়ার দিকনির্দেশনা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।