আন্তর্জাতিক ডেস্ক
২৬ বছর বয়সী তিউনিসীয় ফেরিওয়ালা মোহাম্মদ বৌআজিজি ২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বর পুলিশের হয়রানি ও রাষ্ট্রীয় অবহেলার প্রতিবাদে নিজের গায়ে আগুন দেন। এই ঘটনা আরব বিশ্বে গণআন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায়, যা ‘আরব বসন্ত’ নামে পরিচিত। বেকারত্ব, দুর্নীতি, দমন-পীড়ন ও দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা শাসকদের প্রতি জনসমষ্টির ক্ষোভ তিউনিসিয়ায় এবং পরবর্তীতে অন্যান্য আরব দেশে ব্যাপক বিক্ষোভে পরিণত হয়।
তিউনিসিয়া: ১৯৮৭ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে হাবিব বুরগিবাকে ক্ষমতার অযোগ্য ঘোষণা করে ২৩ বছর বয়সী জিন এল আবিদিন বেন আলি ক্ষমতা দখল করেন। তিনি সাবেক নিরাপত্তা প্রধান হিসেবে কঠোর দমননীতি, নিরাপত্তা সংস্থা-নির্ভর শাসন ব্যবস্থা ও অনুগত রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। অর্থনীতি কিছুটা উদার হলেও দুর্নীতি, বৈষম্য ও গণমাধ্যম সেন্সরশিপ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। বৌআজিজির আত্মাহুতির পর দেশজুড়ে ক্ষোভ বিস্ফোরিত হয় এবং মাত্র ২৮ দিনে বেন আলি সৌদি আরবে পালিয়ে যান। পরবর্তীতে আদালত তার অনুপস্থিতিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন; তিনি ২০১৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর জেদ্দায় মৃত্যুবরণ করেন।
মিশর: ১৯৮১ সালে আনোয়ার সাদাত হত্যাকাণ্ডের পর বিমানবাহিনী প্রধান হোসনি মোবারক প্রেসিডেন্ট হন। জরুরি আইন, সেনাবাহিনীর প্রভাব ও দমননীতির মাধ্যমে তিনি তিন দশক ক্ষমতায় ছিলেন। দুর্নীতি, বেকারত্ব ও রাজনৈতিক দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে ২০১১ সালের ২৫ জানুয়ারি দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। ১৮ দিনের আন্দোলনের পর ১১ ফেব্রুয়ারি মোবারক পদত্যাগে বাধ্য হন। আন্দোলনের সময় বিক্ষোভকারীদের হত্যার অভিযোগে তাকে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হলেও পরে তা বাতিল হয়। দুর্নীতির মামলায় সাময়িকভাবে আটক থাকলেও ২০১৭ সালে মুক্তি পান এবং ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি কায়রোতে মৃত্যু হয়।
ইয়েমেন: উত্তর ইয়েমেন ও একীভূত ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট আলি আবদুল্লাহ সালেহ ২০১১ সালের আন্দোলনের পর ২০১২ সালে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। এরপরও তিনি হুথিদের সঙ্গে জোট বেঁধে ২০১৪ সালে রাজধানী সানা দখলে সহায়তা করেন। ২০১৭ সালে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা ব্যর্থ হলে হুথি বাহিনীর হাতে নিহত হন।
লিবিয়া: ১৯৬৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে রাজতন্ত্র উৎখাত করে ক্ষমতায় আসেন মুয়াম্মার গাদ্দাফি। তেলসম্পদের ওপর ভিত্তি করে তিনি ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। ২০১১ সালে বেনগাজিতে মানবাধিকারকর্মী গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু হয়, যা দ্রুত গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। ন্যাটো অভিযান এবং বিদ্রোহীদের সহায়তায় আগস্টে ত্রিপোলি দখল হয়। অক্টোবরের ২০ তারিখ নিজ শহর সির্তে পালানোর সময় বিদ্রোহীদের হাতে ধরা পড়ে গাদ্দাফি নিহত হন।
সিরিয়া: ২০০০ সালে বাবার মৃত্যুর পর বিশেষ সাংবিধানিক সংশোধনের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট হন বাশার আল-আসাদ। ২০১১ সালে দেরা শহরে স্কুলের দেয়ালে সরকারবিরোধী গ্রাফিতি লেখাকে কেন্দ্র করে আন্দোলন শুরু হয়, যা ভয়াবহ গৃহযুদ্ধে পরিণত হয়। প্রায় ১৪ বছর ধরে চলা সংঘাতের কারণে দেশটির অর্ধেকের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হন। ২০২৪ সালের ৮ ডিসেম্বর হায়াত তাহরির আল-শামের নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহীদের আকস্মিক অভিযানে সিরীয় সেনাবাহিনী ভেঙে পড়ে। দামেস্কে বিদ্রোহীরা ঢোকার পর বাশার আল-আসাদ পরিবারসহ প্লেনে করে রাশিয়ার মস্কোতে চলে যান।
এই আন্দোলনগুলো মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক পরিবর্তনের সূচনা করে। ক্ষমতাচ্যুত শাসকদের অনুপস্থিতিতে দেশগুলো বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামরিক সংঘাতের মুখোমুখি হয়, যা অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ও আন্তর্জাতিক নীতি প্রণয়নে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।