হায়দার আলী; ঢাকার নিউ মার্কেটের গা ঘেঁষা ‘নিউ মার্কেট সিটি কমপ্লেক্স’ নামের ২২ তলাবিশিষ্ট যে বিশাল অট্টালিকা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে, এর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘বিশ্বাস বিল্ডার্স লিমিটেড’। আর এই বিশ্বাস বিল্ডার্সের কর্ণধার ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বাংলাদেশ কৃষক লীগের একজন নেতা, এ তথ্য জানার পর মাথাচাড়া দেয় সাংবাদিকের চিরন্তন কৌতূহল—যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের মতো কৃষক লীগের নেতার হাতেও আজ আলাদিনের চেরাগ! শুরু হয় অনুসন্ধান। বেরিয়ে আসে প্রায় শূন্য থেকে সম্পদের পাহাড়ে ওঠার আরেক অবিশ্বাস্য কাহিনি, যার নেপথ্যে রয়েছে সেই দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির অশুভ চক্র।
জানা গেল, এই ‘কৃষক নেতা’র নাম নজরুল ইসলাম বিশ্বাস ওরফে দুলাল বিশ্বাস। তিনি এখন বাংলাদেশ কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি। তাঁর গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলার আবাইপুর ইউনিয়নের পাঁচপাখিয়া গ্রামে।
অনুসন্ধানের প্রথম পর্যায়েই গত ৬ অক্টোবর এ কৃষক লীগ নেতার উত্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে শৈলকুপা আসনের সংসদ সদস্য ও ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই বলেন, ‘দুলাল বিশ্বাসের বাবা আব্দুর রশিদ বিশ্বাস মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন; কিন্তু স্বাধীনতার পর পথভ্রষ্ট হন। ১৯৭৩ সালে একটি ডাকাতির ঘটনায় তিনি জেলও খাটেন। ছয় বছর পর জেল থেকে বেরিয়ে যোগ দেন বিএনপিতে। এর পর থেকে পুরো পরিবারটিই বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়ায়।’ এমপি বলেন, ‘সেই পরিবারের ছেলে দুলাল বিশ্বাস যেন আলাদিনের চেরাগ হাতে পেয়েছে। অল্প সময়েই অসংখ্য অ্যাপার্টমেন্ট, ফ্ল্যাট, বাড়িসহ কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক বনে গেছে। ঢাকায় তার অফিসে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের পুনর্বাসনকেন্দ্র বানিয়েছে। টাকার জোরে দুলাল এখন কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি হয়েছে।’
স্থানীয় এমপির কথার সূত্র ধরে এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেল, নজরুল ইসলাম বিশ্বাস ওরফে দুলাল বিশ্বাসের একসময় ভিটামাটি ছাড়া তেমন কিছু ছিল না। সংসার চালাতে রাস্তার মাটি কাটা থেকে শুরু করে অন্যের বাড়িতে দিনমজুরি করতেও দেখেছে অনেকে। নব্বইয়ের দশকে তত্কালীন বিডিআরে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন। পরে শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে চাকরিচ্যুত হয়ে জীবিকার তাগিদে চলে আসেন ঢাকায়। অনেক খুঁজে চাকরি পান মুগদার একটি রড-সিমেন্টের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে। ঘটনাচক্রে পরিচয় হয় সেই প্রতিষ্ঠানের মালিকের বিবাহিত মেয়ের সঙ্গে। সেই মেয়ের স্বামী থাকতেন জাপানে, প্রেম শুরু হয় দুলালের সঙ্গে; এরপর বিয়ে। ব্যস, উচ্চাকাঙ্ক্ষী সুদর্শন যুবক দুলাল বিশ্বাস পেয়ে যান ওপরে ওঠার সিঁড়ি; কিন্তু তর সয় না তাঁর। দ্রুতই ভিড়ে যান রাজধানীর দুর্বৃত্তচক্রে। অল্পদিনেই হয়ে ওঠেন টাকার কুমির।
সিনেমার কাহিনীর মতো এসব ঘটনাপ্রবাহ যাঁদের কাছ থেকে জানা গেছে, তাঁদেরই একজন শৈলকুপার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা নায়েব আলী জোয়ার্দার বলেন, দুলাল বিশ্বাসের আগে থাকার জায়গাও ছিল না। আর এখন গাড়ি-বাড়ির অভাব নেই। গ্রামে বানিয়েছেন ৫০ বিঘারও বেশি জমির ওপর রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি।
শৈলকুপার পাঁচপাখিয়া গ্রামে ‘বিশ্বাস বাড়ি’ নামে কৃষক নেতা নজরুল ইসলামের সেই সুরম্য প্রাসাদোপম বাড়ির একটি ভিডিও চিত্র কালের কণ্ঠ’র সংগ্রহে আছে। দীর্ঘ সীমানা প্রাচীরঘেরা, তিনতলার ছাদে হেলিপ্যাডযুক্ত এই ‘বিশ্বাস বাড়ি’র সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ তাকালেই হয়তো অনেকেরই কণ্ঠ থেকে স্বগতোক্তির মতো বের হবে— ‘অবিশ্বাস্য’।
সম্পদের বহর : কৃষক নেতা নজরুল ইসলাম বিশ্বাসের মালিকানাধীন ডেভেলপার কম্পানি বিশ্বাস বিল্ডার্সের সম্পদের বহর এখন ঢাকা ও এর আপপাশে কত দূর ছড়িয়েছে, তার একটি বিবরণ পাওয়া যায় এই ডেভেলপার কম্পানিটির ওয়েবসাইটে। সেখানে বিশ্বাস বিল্ডার্সের এমডি নজরুল ইসলাম ও পরিচালক মো. নূর আলমের ছবিও দেওয়া আছে। এই নূর আলম আবার নজরুল ইসলামের আপন ভাই বলে জানা গেছে। ওয়েবসাইটে দেখা যায়, বিশ্বাস বিল্ডার্সের চলমান প্রকল্পগুলোর মধ্যে আছে ধানমণ্ডিতে ‘জেকে টাওয়ার’, ‘ক্রেডেন্স’ ও ‘বিশ্বাস আম্রঝুড়ি’, গুলশানে ‘গ্রেস’, মিরপুরে ‘বিশ্বাস দিগন্ত’, মিরপুর-৬-এ ‘বিশ্বাস নীলাঞ্জনা’ ও মিরপুর-১০-এ ‘বিশ্বাস মাধবী’, উত্তরায় ‘বিশ্বাস বলাকা’, ‘বিশ্বাস ফাইয়াস’, ‘বিশ্বাস মারজান’ ও ‘বিশ্বাস প্রশান্তি’, পশ্চিম কাফরুলে ‘বিশ্বাস মঈন টাওয়ার’, মহাখালীতে ‘আরজত আলী কমপ্লেক্স’ ও ‘সুলতান প্লাজা’, খিলগাঁওয়ে ‘বিশ্বাস হাসনাহেনা’ ও ‘বিশ্বাস চলন্তিকা’, মোহাম্মদপুরে ‘বিশ্বাস নিহারিকা’ ও ‘কুঞ্জছায়া’, হবিগঞ্জে ‘সাইহাম ফিউচার কমপ্লেক্স’। সম্পন্ন হওয়া প্রকল্প দেওয়া আছে নিউ মার্কেটে ‘নিউ মার্কেট সিটি কমপ্লেক্স’, উত্তরায় ‘বিশ্বাস লেক টাচ’, মোহাম্মদপুরে ‘বিশ্বাস রাতুল’, কমলাপুরে ‘বিশ্বাস ভিলা’ ও ‘বিশ্বাস টাওয়ার’। ‘পূর্বাচল হিল সিটি’ ও ‘লেক সিটি’ নামে ল্যান্ড প্রজেক্টের নাম বলা আছে ওয়েবসাইটে। সেখানে বিশ্বাস বিল্ডার্সের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের তালিকায় আছে বিশ্বাস ট্রেডিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন, বিবিএল এলিভেটর লিমিটেড, বিশ্বাস সিকিউরিটিস অ্যান্ড লজিস্টিকস লিমিটেড, নাফ ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, বিশ্বাস ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ফ্রেন্ডস কনস্ট্রাকশন লিমিটেড, ফাইন ফুডস লিমিটেড ও পার্বণ রেস্টুরেন্ট।
আঙুল ফুলে প্রথম কলাগাছ : ধনী প্রবাসীর স্ত্রীকে ভাগিয়ে বিয়ে করে ওপরে ওঠার সিঁড়ি পাওয়ার পর নজরুল ইসলাম বিশ্বাসের প্রথম যে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়, সেটি হলো নিউ মার্কেট সিটি কমপ্লেক্স। গত রবিবার দুপুরে বিশাল ভবনটির ছবি তোলার সময় এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক ছোট্ট একটি পলিথিন ব্যাগে কাঁচামরিচ নিয়ে ফেরার পথে থেমে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন ছুড়লেন, ‘কিসের ছবি তোলেন?’
‘এই ভবনের’ উত্তর দিলে ফের প্রশ্ন, ‘আপনি কে? কেন ছবি তোলেন?’
‘আমি সাংবাদিক’ জানালে ভদ্রলোক একটু থেমে চেহারাটা ভালো করে দেখে নিয়ে বললেন, ‘আসেন, আমার সঙ্গে। এই ভবনের ভেতরে কত কাহিনী, শুনে যান।’
মেঘ না চাইতেই জলের মতো উচ্ছলিত হয়ে চললাম তাঁর পিছে। নিয়ে গেলেন পাশের একটি হোটেলে। চা খেতে খেতে জানা গেল, ভদ্রলোকের নাম ইস্রাফিল হোসেন। তিনি বিশাল এই নিউ মার্কেট সিটি কমপ্লেক্সের অন্যতম অংশীদার। বললেন, ২০০৫ সালের দিকে একটি ভাঙাচোরা গাড়িতে চড়ে সুদর্শন চেহারার এক ভদ্রলোক এসে বললেন, তাঁকে এই জমিটি দিলে তিনি এটা ডেভেলপ করবেন। এখানে বিশাল ভবন বানাবেন, আমরা সবাই একাধিক দোকান-ফ্ল্যাট পাব; আরো কত কী! কত মিষ্টি মিষ্টি কথা!’ ইস্রাফিল একটু দম নিয়ে আবার বলতে থাকেন, ‘কে জানত, ওই মিষ্টি মুখের লোকটির ভেতর যে এত বিষ থাকতে পারে! আমরা বাপ-দাদা, ভাই-বেরাদার ৭৪ জন শরিক; আমাদের পাওনা অংশ নামমাত্র ধরিয়ে দিয়ে পুরোটাই দখল করে রেখেছে দুলাল বিশ্বাস। ২২ তলার এ ভবনের ওপরের ১৭টি তলায় আবাসিক ফ্ল্যাট রয়েছে ২৬৭টি। আর নিচের তলাগুলোতে দোকানঘর রয়েছে প্রায় ৭০০। আমাদের জমিতে ভবন নির্মাণের চুক্তি করা থেকেই শুরু হয় তাঁর প্রতারণা। আমরা প্রতিবাদ শুরু করলে সে নিয়ে আসে সন্ত্রাসী-ক্যাডার বাহিনী। নির্যাতন-হামলা-মামলায় জর্জরিত করে ফেলে আমাদের। সম্রাটকে দিয়েও নাজেহাল করে আমাদেরকে।’
‘কোন সম্রাট?’
ইস্রাফিল হোসেনের বর্ণনায় জানা গেল, এই সম্রাট ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, যিনি এখন ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে গ্রেপ্তার। সম্রাট নাকি প্রায়ই এখানে এসে মহড়া দিত।
নিউ মার্কেট সিটি কমপ্লেক্সের ভেতরের কাহিনী পার্শ্ব প্রতিবেদনে বিস্তারিত লেখা হলো।
এর আগে গত ৬ অক্টোবর ঝিনাইদহের শৈলকুপার মুক্তিযোদ্ধা মুক্তার আহমেদ মৃধা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নজরুল ইসলাম দুলাল ও তাঁর পরিবারের সবাই বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। সেই দুলাল এখন কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা হয়ে গেছেন। ১৬-১৭ বছরের ব্যবধানে শূন্য থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন।
পদ বাগিয়ে কৃষক নেতা : ঝিনাইদহের শৈলকুপায় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে টানানো পোস্টার-ব্যানারে দেখা যায়, নজরুল ইসলাম বিশ্বাসের পরিচয় লেখা আছে আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ কৃষক লীগ। পরে গত ১ আগস্ট থেকে হঠাৎ তাঁর পরিচয় দাঁড়ায় কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন কৃষক লীগের গঠনতন্ত্রের ২ ধারায় সংগঠনের মূলনীতিতে বলা আছে “বাঙালী জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও ‘কৃষক বাঁচাও-দেশ বাঁচাও’ মূলমন্ত্রে সারা দেশে কৃষকসমাজকে সংগঠিত করিয়া কৃষক-জনতার সার্বিক উন্নয়ন সাধন করা।” গঠনতন্ত্রের ৮ নম্বর ধারায় ‘সদস্য পদ’-এ বলা আছে, ‘গঠনতন্ত্রে উল্লিখিত মূলনীতিতে বিশ্বাসী ন্যূনতম ১৮ বছর বয়সোর্ধ্ব নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে বাংলাদেশের যে কোন কৃষক ও কৃষি পেশার সাথে সম্পর্কযুক্ত যে কোন ব্যক্তি, কৃষকের স্বার্থসংশ্লিষ্ট যে কোন ব্যক্তি, কৃষক দরদি, বিশিষ্ট ব্যক্তি,…বাংলাদেশ কৃষক লীগের সদস্য হইতে পারিবেন।’
নজরুল ইসলাম বিশ্বাসের মতো একজন বিতর্কিত ‘অকৃষক’ ব্যবসায়ী কী করে কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদ পেলেন জানতে চাইলে বাংলাদেশ কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক রেজা গত রবিবার বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা স্বাক্ষরিত কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির ১১১ সদস্যের তালিকায় নজরুল ইসলাম ওরফে দুলাল বিশ্বাসের নাম নেই। আমি দেশের বাইরে থাকার সময় সভাপতি মোতাহার হোসেন মোল্লা গত ৩১ জুলাই দুলাল বিশ্বাসকে নিয়মবহির্ভূতভাবে কৃষক লীগের নেতা বানিয়েছেন। ওই বিষয়ে আমাকে কিছু জানানো হয়নি। কৃষক লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নেত্রীর স্বাক্ষরিত কমিটির তালিকার বাইরে অন্য কাউকে সভাপতি ইচ্ছা করলেই নিতে পারেন না।’
কৃষক লীগের আরেকজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘দুলাল বিশ্বাসের মতো জামায়াত-বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিকে সভাপতি মোটা অঙ্কের টাকা খেয়ে সহসভাপতি পদ দিয়েছেন। সভাপতি একাধিকবার হেলিকপ্টারে করে দুলালের সঙ্গে তাঁর শৈলকুপার বাড়িতে গেছেন।’ ওই নেতা আরো বলেন, এর আগে দুলাল নিজেকে আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক পরিচয় দিতেন। কিন্তু কাগজে-কলমে কোনো কমিটিতে নজরুল ইসলাম দুলালের নাম নেই।
অভিযোগ তুলে ধরে কৃষক লীগের সভাপতি মোতাহার হোসেন মোল্লার সঙ্গে যোগাযোগ করলে গত রবিবার তিনি টাকা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া তালিকায় নজরুল ইসলাম বিশ্বাসের নাম না থাকলেও পরে কমিটির সবার মতামতের ভিত্তিতে তাঁকে নেওয়া হয়েছে। তখন সেক্রেটারি হজ করার জন্য সৌদি আরবে গেলে ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারির সঙ্গে আলোচনা করে নজরুল বিশ্বাসকে সহসভাপতির পদ দেওয়া হয়।’
‘গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এটা আপনারা পারেন কি না’ প্রশ্ন করলে সভাপতি বলেন, ‘তা অবশ্য পারি না। এটা ভুলই হয়ে গেছে। সে যে বিএনপি-জামায়াতের লোক, তা আমাদের জানা ছিল না।’
অবশেষে নাগাল মিলল কৃষক নেতার : অভিযোগ প্রসঙ্গে বক্তব্য জানার জন্য গত ৫ অক্টোবর সকালে নিউ মার্কেট সিটি কমপ্লেক্সের কার্যালয়ে গেলে সেখানকার স্টাফরা বলেন, ‘স্যার অফিসে নাই।’ বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও ওই দিন নজরুল ইসলাম বিশ্বাসের দেখা মেলেনি। পরদিন তাঁর মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
কিছুতেই এ কৃষক নেতার নাগাল না পেয়ে শেষমেশ তাঁর বাসস্থানের ঠিকানা জোগাড় করে গত রবিবার সকালে রওনা হই ধানমণ্ডিতে। সকাল ১১টায় ৫ নম্বর রোডের ৩১/১ নম্বর বাড়ির গেটের সামনে পৌঁছলে এগিয়ে আসেন নিরাপত্তারক্ষী হাফিজুর রহমান। ‘এটা কি দুলাল বিশ্বাসের বাড়ি?’
‘জি।’
‘তিনি কি বাড়িতে আছেন?’
নিরাপত্তারক্ষী বললেন, ‘স্যার আছেন; কিন্তু আপনি কোত্থেকে এসেছেন?’ নিজের পরিচয় দিলে তিনি ভেতরে গিয়ে দুলাল বিশ্বাসের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা বেলাল হোসেনকে ডেকে আনলেন। ‘দুলাল বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা করতে চাই’ জানালে বেলাল হোসেন বললেন, ‘বাইরের লোকজনের সঙ্গে স্যার বাড়িতে কথা বলেন না। পরে ফোন করে অফিসে চলে আসেন।’
‘কিন্তু বারবার ফোন দিলেও তিনি ফোন ধরছেন না, এ জন্যই দেখা করতে এসেছি; দেখা করাটা আমার খুব জরুরি’ ইত্যাদি বলে অনেক অনুনয়-অনুরোধ করলেও তাঁরা অপারগতা প্রকাশ করলেন। কিছুতেই ভেতরে ঢুকতে দিলেন না।
শেষমেশ ধরাছোঁয়ার বাইরের এ কৃষক নেতার নাগাল মিলল গতকাল বুধবার দুপুরে। নেতার এক ঘনিষ্ঠজন ফোন করে ডেকে নিয়ে যান কথা বলিয়ে দেওয়ার জন্য। ঢাকার একটি হোটেলে নেতার মুখোমুখি বসে অনেক কথার মধ্যে প্রসঙ্গ ওঠে একজন কৃষক নেতার এত সম্পদের মন্ত্র কী! কৃষক নেতা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বিডিআরের চাকরি খোয়ানোর পর আমি ১৯৯৫ সাল থেকে ঠিকাদারি করি। সেই ব্যবসার টাকায় ধীরে ধীরে এ পর্যন্ত এসেছি। বিএনপির আমলেই আমার অনেক টাকা হয় ঠিকাদারি করে। টাকা না থাকলে সিটি কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ কিভাবে শুরু করি?’
‘নিউ মার্কেটের ওই জমির মালিকদের অনেকে প্রাপ্য অংশ বুঝে পাননি, অনেকে প্রতিবাদ করতে গিয়ে নির্যাতন-মামলার শিকার হয়েছেন’ অভিযোগ প্রসঙ্গে নজরুল ইসলাম অস্বীকার করে উল্টো বলেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের কাছেই আমি টাকা পাই। আর আমি কাউকে মামলা দিইনি, উল্টো তারাই মামলা দিয়েছে। তবে হ্যাঁ, একটি মামলা আমি দিয়েছিলাম, ১০০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ মামলা। তারা মামলা দিয়ে আমার নির্মাণকাজ বন্ধ রেখে কোটি কোটি টাকার ক্ষতিসাধন করছিল। তবে সবাইকেই প্লট বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
যুবলীগের সম্রাটের যোগসাজশের প্রসঙ্গে নজরুল বলেন, ‘একই দলের রাজনীতি করি, পরিচয় এবং জানাশোনা থাকতেই পারে। তিনি নিউ মার্কেট সিটি কমপ্লেক্সের রেস্টুরেন্টে যুবলীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে যেতেও পারেন। কিন্তু তাঁর মাধ্যমে ভয়ভীতি দেখানোর কথা পুরোটাই মিথ্যাচার। আর টাকা দিয়ে কৃষক লীগের পদ কেনার কথাও আমার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মিথ্যাচার।
খোঁজ নিতে নিতে মিলল কৃষক নেতা নজরুল বিশ্বাসের নিজের এলাকায় অবিশ্বাস্য সব নির্যাতন কাহিনি। বিএনপি আমলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা তাঁর ক্যাডার বাহিনীর হাতে হামলা-মামলায় জর্জরিত হয়েছেন। একজন মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে এক সপ্তাহে ১৭টি মামলা করার রেকর্ডও আছে। আবার আওয়ামী লীগ আমলেও ঘটছে একই ঘটনা, ওই মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁর ছেলে-সমর্থকদের নামে আরো ৯টি মামলা ঠুকে দেয় নজরুল বিশ্বাসের লোকজন। এসব ঘটনার অনুসন্ধান শেষে ছাপা হবে আরো প্রতিবেদন।