ডেস্ক
ঢাকা, ৩০ ডিসেম্বর: বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপারসন ও তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জানাজা উপলক্ষে আগামীকাল বুধবার (৩১ ডিসেম্বর) রাজধানীতে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ নিয়মিত সময়সূচির বাইরে অতিরিক্ত বিশেষ মেট্রো ট্রেন সার্ভিস পরিচালনা করবে। ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর জানাজায় অংশগ্রহণকারী যাত্রীদের যাতায়াত নির্বিঘ্ন করতে ৩১ ডিসেম্বর ডিএমটিসিএল নিয়মিত সময়সূচির অতিরিক্ত বিশেষ মেট্রো ট্রেন পরিচালনা করবে। মূলত এমআরটি লাইন–৬ (উত্তরা উত্তর থেকে মতিঝিল রুট)–এ যাত্রীচাপ বৃদ্ধির সম্ভাবনা বিবেচনায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মেট্রোরেল পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, যাত্রীদের সুবিধা ও শৃঙ্খলাপূর্ণ যাতায়াত নিশ্চিত করাই বিশেষ সার্ভিস পরিচালনার মূল উদ্দেশ্য।
বিএনপির পক্ষ থেকে আগেই জানানো হয়েছে, বুধবার বাদ জোহর দুপুর ২টায় খালেদা জিয়ার জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। জানাজার প্রধান আয়োজন জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা মাঠে এবং মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ সংলগ্ন এলাকায় সম্পন্ন হবে। জানাজায় অংশ নিতে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের সমাগম ঘটতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ উপলক্ষে ঢাকার গণপরিবহন, বিশেষ করে মেট্রোরেল, বাস ও সড়কপথে বাড়তি যাত্রীচাপ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
মেট্রোরেল বাংলাদেশের নগর গণপরিবহন ব্যবস্থায় সাম্প্রতিক সময়ে যুক্ত হওয়া সবচেয়ে দ্রুত, সময়-সাশ্রয়ী ও শৃঙ্খলাপূর্ণ পরিবহন মাধ্যম। ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে এমআরটি লাইন–৬ উদ্বোধনের মাধ্যমে রাজধানীতে মেট্রোরেলের যাত্রা শুরু করেন। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে উত্তরা উত্তর থেকে আগারগাঁও, আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশ চালু করা হয়। বর্তমানে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত সম্পূর্ণ রুটে বাণিজ্যিক মেট্রো সার্ভিস চালু রয়েছে, যা দৈনিক লাখো যাত্রী পরিবহন করছে। দ্রুতগতির এই পরিবহন ব্যবস্থা সড়কজট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও বিশেষ আয়োজন বা জনসমাগমকেন্দ্রিক পরিস্থিতিতে যাত্রী ব্যবস্থাপনা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে। সেই বাস্তবতা মাথায় রেখে খালেদা জিয়ার জানাজা উপলক্ষে বিশেষ মেট্রো সার্ভিস যুক্ত করা হয়েছে।
বেগম খালেদা জিয়া ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট তৎকালীন দিনাজপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর তিনি সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন এবং ১৯৮৪ সালে বিএনপির নেতৃত্বে যুক্ত হন। ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পর তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন। পরবর্তীতে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনেও বিএনপির নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার শাসনামলে বাংলাদেশের আর্থ–সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন, নারী নেতৃত্বের বিকাশ এবং বহুদলীয় গণতান্ত্রিক চর্চা জোরদারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আলোচিত হয়েছে। একইসঙ্গে তার রাজনৈতিক জীবনে নানা উত্থান–পতন, আন্দোলন–সংগ্রাম, কারাবাস ও আইনি লড়াইও ছিল বহুল আলোচিত।
মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) সকালে এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যু হয়। দীর্ঘদিন ধরে তিনি নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। তার মৃত্যু সংবাদ প্রকাশের পর রাজনৈতিক অঙ্গন, কূটনৈতিক মহল ও সাধারণ নাগরিকদের মাঝে শোকের আবহ ছড়িয়ে পড়ে। বিএনপি তার মৃত্যুতে দেশব্যাপী শোক কর্মসূচি ঘোষণা করে। দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ বিভিন্ন জেলা ও মহানগরে কালো পতাকা উত্তোলন, মিলাদ মাহফিল, শোক র্যালি ও আলোচনা সভা আয়োজন করা হয়েছে। পাশাপাশি জানাজার প্রস্তুতিও চলছে ব্যাপক পরিসরে। জানাজা উপলক্ষে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা ও মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা, জনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, স্বেচ্ছাসেবী ব্যবস্থাপনা এবং ট্রাফিক সমন্বয়ের প্রস্তুতি নিয়েছে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক সংস্থাগুলো।
খালেদা জিয়ার জানাজার পর তাকে ‘জিয়া উদ্যানে’ দাফন করা হবে—এটি বিএনপির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছে। জিয়া উদ্যানে তার স্বামী, স্বাধীনতার ঘোষক ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সমাধি রয়েছে। জানাজা শেষে তাকে সমাধির পাশেই শায়িত করা হবে। এটি বিএনপির নেতাকর্মীদের কাছে আবেগঘন ও প্রতীকী একটি সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সমাধি প্রাঙ্গণকে ঘিরে এরইমধ্যে প্রস্তুতি, সাজসজ্জা ও ভিড় ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা সাজানো হয়েছে।
রাজধানীতে বড় রাজনৈতিক বা জাতীয় আয়োজনে মেট্রোরেলের বিশেষ ট্রেন পরিচালনা এর আগেও দেখা গেছে। বিশেষ করে জাতীয় অনুষ্ঠান, সমাবেশ, কনসার্ট বা ক্রীড়া আয়োজনের দিনে যাত্রীচাপ বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে ডিএমটিসিএল অতিরিক্ত ট্রেন সার্ভিস যুক্ত করেছে। তবে কোনো জাতীয় নেতার জানাজা উপলক্ষে মেট্রোরেলের বিশেষ ট্রেন পরিচালনা একটি ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। এটি নগর যাতায়াত ব্যবস্থাপনায় রাষ্ট্রীয় ও নাগরিক সুবিধা নিশ্চিতের একটি বাস্তবসম্মত উদ্যোগ হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
ডিএমটিসিএল যাত্রীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, বিশেষ সার্ভিস চলাকালে স্টেশন ও ট্রেনে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে, নির্দেশনা অনুসরণ করতে এবং অতিরিক্ত ভিড়ের সময়ে ধৈর্য ধারণ করতে। মেট্রো স্টেশনগুলোতে বাড়তি নিরাপত্তা কর্মী ও ভিড় নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ করা হবে বলেও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। প্রতিটি স্টেশনে যাত্রী প্রবেশ–বহির্গমন, প্ল্যাটফর্ম ব্যবস্থাপনা ও ট্রেন ছাড়ার সময় সমন্বয়ে বিশেষ নজর রাখা হবে।
বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে বাংলাদেশ রাজনীতিতে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তার জানাজা ও দাফন আয়োজনকে ঘিরে রাজধানী ঢাকা এখন প্রস্তুত এক ঐতিহাসিক জনসমাগম প্রত্যক্ষ করতে। যাত্রী পরিবহন নির্বিঘ্ন করতে মেট্রোরেলের বিশেষ ট্রেন পরিচালনা এই আয়োজনে নগর–সমন্বয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে থাকছে।