জাতীয় ডেস্ক
বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে আগামীকাল বুধবার (৩১ ডিসেম্বর) নির্বাহী আদেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব এ বি এম আবু বাকার ছিদ্দিক স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে এ সিদ্ধান্ত জানানো হয়। পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকার বুধবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে। শোককালীন সময়ে দেশের সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবন এবং বিদেশে বাংলাদেশ মিশনে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে ৩১ ডিসেম্বর এক দিনের সরকারি ছুটি থাকবে। এদিন দেশের সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকবে। তবে জরুরি পরিষেবাসমূহ এই ছুটির আওতাবহির্ভূত রাখা হয়েছে। বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস ও অন্যান্য জ্বালানি সেবা, ফায়ার সার্ভিস, সমুদ্র ও স্থলবন্দরসমূহের কার্যক্রম, পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম, টেলিফোন, ইন্টারনেট, ডাকসেবা এবং সংশ্লিষ্ট সেবায় নিয়োজিত যানবাহন ও কর্মীরা ছুটির বাইরে থাকবে। হাসপাতাল, জরুরি চিকিৎসাসেবা, চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী এবং ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম বহনকারী যানবাহন ও কর্মীরাও এই ছুটির আওতাবহির্ভূত রাখা হয়েছে। জরুরি কাজে সম্পৃক্ত অফিস ও প্রতিষ্ঠানসমূহও প্রয়োজন অনুযায়ী খোলা থাকবে।
প্রজ্ঞাপনে আরও উল্লেখ করা হয়, ব্যাংক ও আদালতের কার্যক্রমের বিষয়ে যথাক্রমে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সুপ্রিম কোর্ট প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করবে। রাষ্ট্রীয় শোকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বুধবার থেকে শুক্রবার (৩১ ডিসেম্বর–২ জানুয়ারি) পর্যন্ত তিন দিন রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হবে। এ সময় দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি ভবন, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিদেশে বাংলাদেশ মিশনে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, শোক পালন উপলক্ষে এই তিন দিন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা ও কর্মসূচি স্থগিত বা সীমিত রাখা হতে পারে।
বেগম খালেদা জিয়া ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী রাজনীতিতে তার উত্থান ও নেতৃত্ব দেশীয় রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখেছে। ১৯৭৮ সালে বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর দলটির রাজনীতিতে খালেদা জিয়া ধীরে ধীরে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৯৮১ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর দলের রাজনীতিতে তার ভূমিকা আরও সুদৃঢ় হয়। ১৯৮৩ সালে তিনি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং ১৯৮৪ সালে দলের চেয়ারপারসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর থেকে দীর্ঘ সময় ধরে তিনি বিএনপির নেতৃত্বে থেকে দলীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছেন।
১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করলে খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি পুনরায় জয়ী হলে তিনি দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। তার শাসনামলে অর্থনীতি, অবকাঠামো, শিক্ষা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিভিন্ন উদ্যোগ ও নীতি-সংস্কার গ্রহণ করা হয়। তবে একই সময়ে রাজনৈতিক বিরোধ, আন্দোলন, হরতাল ও সরকারবিরোধী কর্মসূচি—রাজনৈতিক সংঘাতের ক্ষেত্রেও তার সময়কাল বিশেষভাবে আলোচিত।
২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার পর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে পরিবর্তন আসে। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে বিএনপি সংসদে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করে। পরবর্তী সময়ে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে বিএনপি ও সরকারদলীয় রাজনৈতিক বিরোধ ও আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়, যার ফলে রাজনৈতিক উত্তাপ ও সংঘাতের পরিসর বিস্তৃত হয়।
আইনি ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ২০১৮ সালে খালেদা জিয়াকে দুর্নীতি মামলায় সাজা দেওয়া হয়। সাজা ঘোষণার পর থেকে তিনি কারাবন্দী ছিলেন এবং পরবর্তীতে ২০২০ সালে সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে সাময়িক মুক্তি পান। এরপর থেকে দীর্ঘ সময় ধরে তিনি বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। ২০২১ সালের পর থেকে তার চিকিৎসা কার্যক্রম ঘন ঘন হাসপাতালকেন্দ্রীক হয়ে পড়ে। সর্বশেষ ২০২৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুতে দেশজুড়ে শোকের পরিবেশ বিরাজ করছে।
বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যু বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি। তার রাজনৈতিক পথচলা, নেতৃত্ব, জনপ্রিয়তা, সমর্থকভিত্তি এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় তার ভূমিকা—বাংলাদেশের রাজনীতিতে গভীর ছাপ রেখে গেছে। সরকারের সাধারণ ছুটি ও রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণার সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রীয়ভাবে এই নেত্রীর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের একটি আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
রাষ্ট্রীয় শোক ও সাধারণ ছুটির ফলে বুধবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত জাতীয় পর্যায়ে সরকারি কর্মকাণ্ড, প্রশাসনিক কার্যক্রম, সামাজিক ও আনুষ্ঠানিক কর্মসূচিতে পরিবর্তন ও সমন্বয় দেখা যাবে। জরুরি পরিষেবাসমূহ চালু রেখে সরকারি ছুটি ঘোষণার ফলে জনজীবনে মৌলিক সেবা অব্যাহত থাকবে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নিশ্চিত করেছে।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, বুধবার সব সরকারি ও বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকলেও চিকিৎসা, বিদ্যুৎ, বন্দর, জ্বালানি, ফায়ার সার্ভিস ও যোগাযোগ-সংশ্লিষ্ট জরুরি সেবাসমূহ স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু রাখবে। রাষ্ট্রীয় শোক চলাকালে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার সিদ্ধান্ত দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও বাংলাদেশ মিশনসমূহে কার্যকর থাকবে।