ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেডের (আইএলএফএসএল) দুর্নীতির বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের সঙ্গে মিল নেই বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে। এত দিন সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের খবর সবাই জেনে এলেও সুপ্রিম কোর্টে দাখিল করা বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে ১ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকার হিসাব। বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগও। গতকাল এ-সংক্রান্ত শুনানিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালকের উদ্দেশে আদালত বলেছে, এটা শুভঙ্করের ফাঁকি কি না? পি কে হালদারের সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা লুটপাট নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকার সমালোচনাও করেছে সর্বোচ্চ আদালত। এদিন শুনানিতে হাজির হয়ে কোম্পানিটির বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতি আদালতে তুলে ধরেন উচ্চ আদালতের আদেশে নিযুক্ত স্বাধীন চেয়ারম্যান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। তিনি বলেন, পিপলস লিজিংকে অবসায়ন করা হয়েছে। এখন যদি একইভাবে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেডকেও অবসায়ন করা হয়, তাহলে আর্থিক খাতে ধস নামতে পারে। শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এখন অনেকেই ব্যাংক করেন জনগণের টাকা লুটের জন্য। এ বিষয়ে আদালতের দেখা উচিত। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে শুনানি ছিলেন আইনজীবী তানজীব-উল আলম, আর ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেডের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী আহসানুল করিম। শুনানি শেষে সর্বোচ্চ আদালত আজ বুধবার আদেশের জন্য রাখে। ১৬ ফেব্রুয়ারি ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেডের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে আদালতের নির্দেশে নিযুক্ত চেয়ারম্যান ইব্রাহিম খালেদ ও বাংলাদেশের ব্যাংকের একজন নির্বাহী কর্মকর্তাকে আদালতে ডাকে আপিল বিভাগ। কোম্পানির আর্থিক অবস্থা, দুর্নীতির ব্যাপ্তি, অবসায়ন সম্ভব কি না, সর্বোপরি সামগ্রিক বিষয়ে লিখিত বক্তব্য নিয়ে আদালতে হাজির থাকতে বলা হয়েছিল তাদের। সে অনুযায়ী গতকাল সকালে তারা সর্বোচ্চ আদালতে এসে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেন। আদালত কর্তৃক নিয়োজিত ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেডের চেয়ারম্যান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ আদালতে বলেন, ২০১৫ সাল পর্যন্ত ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেড খুবই ভালোভাবে চলছিল। ২০১৬ সাল থেকে এর অবস্থা খারাপ হতে থাকে। এর পেছনে মুখ্য ব্যক্তি হিসেবে কাজ করেছেন প্রশান্ত কুমার হালদার। তার সঙ্গে আরও অনেকেই রয়েছেন। এরা একসঙ্গে অনেক শেয়ার কিনে কোম্পানিটির আগের নেতৃত্বকে বের করে দিয়েছেন। বের করে দেওয়া মানে, কাউকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, কাউকে বাধ্যতামূলক অবসরে যেতে বাধ্য করা হয়েছে অথবা ছাঁটাই করা হয়েছে। পি কে হালদারের আত্মসাৎকৃত টাকার হদিস নেই উল্লেখ করে তিনি আদালতকে জানান, পি কে হালদারসহ কিছু ব্যক্তি এই কোম্পানি থেকে ১ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে তা লেখা আছে। এই টাকা ফেরত আসার সম্ভাবনা নেই। টাকা কোথায় আছে এর হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। দেশেও থাকতে পারে, দেশের বাইরেও যেতে পারে। এ টাকা উদ্ধারে রিকভারি এজেন্ট নিয়োগের বিষয়ে নিজের মতামত জানান তিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এ ডেপুটি গভর্নর বলেন, পিপলস লিজিংকে অবসায়ন করা হয়েছে। এখন যদি একইভাবে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেডকেও অবসায়ন করা হয়, তাহলে আর্থিক খাতে ধস নামতে পারে। তিনি বলেন, ‘আবার বর্তমান অবস্থা থেকে এই প্রতিষ্ঠানটাকে কতটুকু দাঁড় করানো যাবে, তা নিয়েও আমি সন্দিহান। আমি সাহস পাচ্ছি না। হাই কোর্টের আদেশে আমাকে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান করা হয়েছে। বাইরে থেকে এসে আমি এটাকে কতটা দাঁড় করাতে পারব! শর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে আমি কী করতে পারি!’ এ সময় প্রধান বিচারপতি কোম্পানিটির আমানতকারীদের অবস্থা জানতে চাইলে ইব্রাহিম খালেদ বলেন, টাকা তো নেই। তারা চাইলেও টাকা ফেরত দেওয়া যাচ্ছে না। এ পর্যায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. শাহ আলম আদালতকে বলেন, ‘এই (ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেড) কোম্পানিটির মূলধনে ৪৫০ কোটি ১৯ লাখ টাকা ঘাটতি রয়েছে। ব্যাংক ঋণ আছে ৯৫৭ কোটি ১৪ লাখ টাকা। সর্বমোট ঋণ হচ্ছে ৩ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা।’ বাংলাদেশ ব্যাংক এই পরিস্থিতিতে কী পদক্ষেপ নিয়েছেÑ প্রধান বিচারপতির এমন প্রশ্নে এ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা দিয়েছি। কখনো কখনো বাস্তবায়ন করেছে, কখনো কখনো বাস্তবায়ন করেনি।’ তিনি বলেন, ‘বিধিবহির্ভূতভাবে টাকা নিয়ে যাওয়ায় মূলধনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যানশিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছে। এরই মধ্যে একটি প্রতিবেদন জমাও দিয়েছে। মোট ৪৮টি ঋণ হিসাবের সঙ্গে ১২টি প্রতিষ্ঠান ও কতিপয় ব্যক্তির বিপরীতে মোট ১ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এই ৪৮টি ঋণ হিসাবের লেনদেন ভাউচার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। সুবিধাভোগী কারা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। নতুন নিযুক্ত স্বাধীন চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে কোম্পানিটি পুনর্গঠন করা সম্ভব বলে মনে করছি।’ এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা দেখলাম একজনই সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা নিয়েছেন। আপনাদের হিসাব কি শুভঙ্করের ফাঁকি?’ জবাবে নির্বাহী পরিচালক মো. শাহ আলম বলেন, ‘পি কে হালদারসহ অন্যরা এই কোম্পানি থেকেই সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা নিয়েছেন এমনটা বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে আমরা পাইনি।’ এরপর ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেড নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন তুলে ধরেন আইনজীবী তানজীব-উল আলম। ওই প্রতিবেদন তুলে ধরে বলা হয়, ‘যারা শেয়ার নিয়ে কোম্পানিটি দখল করেছে, তারা ডাকাতির জন্যই এসেছিল।’ শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘কিছু লোক কিছু লেখাপড়া শেখে জনগণের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য। এরা হোয়াইট কলার ক্রিমিনাল। এদের কাজই হচ্ছে জনগণের টাকা হাতিয়ে নেওয়া। পি কে হালদার কীভাবে চলে গেল সেটা আপনাদের (আদালতের) দেখা উচিত। কোম্পানি চলবে কি চলবে না, সে বিষয়ে আপনারা সিদ্ধান্ত নেন।’ তিনি বলেন, ‘আগে তো ব্যাংক ছিল না। মানুষ গোলায় ধান রাখত। এটাই ছিল গ্রামীণ অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য। কিন্তু মানুষ এখন ব্যাংকে টাকা রাখে। এখন অনেকেই ব্যাংক করেন জনগণের টাকা লুটের জন্য।