আহসাজগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক শিক্ষার্থী ফ্রিল্যান্সিংয়ের নামে প্রতারণা, হয়রানি ও আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এই অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয়েরই আরেক দল শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে। তবে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীরাও নিজেদের একপ্রকার ভুক্তভোগী বলে দাবি করছেন। বিভিন্ন ফ্রিল্যান্সিং সংগঠনের প্রলোভনে পড়ে শিক্ষার্থীরা এসবে জড়িয়ে পড়ছেন।
ভুক্তভোগী একদল শিক্ষার্থীর অভিযোগ, এনেক্স ওয়ার্ল্ড ওয়াইড’র সিগনেচার মাইন্ড ইনস্টিটিউটে ডিজিটাল মার্কেটিং শেখানো ও ই-কমার্স সাইট থেকে আয় করার আশ্বাসে অভিযুক্তদের মাধ্যমে তারা ৬-১০ হাজার টাকা দিয়ে ভর্তি হন। তবে ভর্তির পর নামমাত্র ক্লাসের আড়ালে নিজের রেফারেন্স দিয়ে প্রতিষ্ঠানে আরো লোক আনতে বাধ্য করা, নির্ধারিত কোর্স না পাওয়ায় আর্থিক ক্ষতি, নানা ধরনের চাপ প্রয়োগসহ বেশকিছু সমস্যার সম্মুখীন হন তারা। এখন জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপসহ ভর্তির টাকা ফেরত চান এসব শিক্ষার্থীরা।
জানা যায়, গত বছরের লকডাউন ও করোনাকালীন বন্ধের ফলে শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। তখন বিশ্ববিদ্যালয়েরই একদল শিক্ষার্থী তাদেরকে ফ্রিল্যান্সিং করে টাকা ইনকামের কথা জানায়। শিক্ষার্থীরা তখন অল্প টাকায় ভর্তি হয়ে টাকা ইনকাম হবে এই ভেবে ভর্তি হবার জন্য সম্মত হয়।
তবে ভর্তি হবার পূর্বে তাদেরকে ফ্রিল্যান্সিংয়ের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা, ডিজিটাল মার্কেটিং শেখার পাশাপাশি প্রোডাক্ট সেল, ক্যারিয়ারসহ বিভিন্ন প্রলোভন দেখানো হয়। ভর্তির পর শিক্ষার্থীদেরকে ওই সংগঠন থেকে চাপ দেয়া হয় নিজের রেফারেন্সে আরো লোক আনার জন্য। এক্ষেত্রে জনপ্রতি ৫০০ টাকা কমিশন অফার করা হয়। নামমাত্র ক্লাস হলেও নির্ধারিত কোর্সের কোনো মিল পায়নি শিক্ষার্থীরা।
অপরদিকে যারা লোক আনার অস্বীকৃতি জানায় তাদেরকে কোর্স না দেয়া, নির্দিষ্ট গ্রুপ থেকে বের করে দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটে। এক্ষেত্রে যারা এসব শিক্ষার্থীদের উপর থেকে যারা নিয়ন্ত্রণ করতো, তারাই ছিল মুখ্য ভূমিকায়। বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক এসব ফ্রিল্যান্সিং সংগঠনের বেশ কয়েকটি গ্রুপ রয়েছে। প্রতিটি গ্রুপে টিমলিডার আলাদা আলাদা ব্যক্তি হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে অনেক শিক্ষার্থী আবার মাধ্যমে হিসেবেও কাজ করে। যারা অন্যদের বিভিন্ন ভাবে বুঝিয়ে এখানে ভর্তি করায়।
ভুক্তভোগী ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী তাহমিনা আক্তার শ্রেয়সি বলেন, সিগনেচার মাইন্ডে ফ্রিল্যান্সিং কোর্সে ভর্তির পূর্বে সেমিনারে যাই প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে জানার জন্য। সেমিনারে বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক সিনিয়র ভাই ও জুনিয়রের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাই ভেবেছিলাম হয়ত ভালোভাবেই ডিজিটাল মার্কেটিং শেখানো হবে। কিন্তু ৬ হাজার টাকা দিয়ে ভর্তি হবার পর ক্লাসের আড়ালে তারা আমাকে দিয়ে কমিশনের ভিত্তিতে আরো লোক ভর্তি করানোর জন্য চাপ প্রয়োগ করে। আমি এটা করতে রাজি না হওয়ায় আমাকে কোর্সও দেয়া হয়নি। অনেক চেষ্টা ও অনুরোধ করার পর তারা একটি কোর্স দেয়। তবে এসব কোর্সে তেমন কিছুই ছিলো না।
একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, সিগনেচার মাইন্ড ইন্সটিটিউটের কথিত এজিএম ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থী সাব্বির হাসানের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ব্যাচের অনেক শিক্ষার্থী ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের কোর্সে ভর্তি হয়ে প্রতারিত হয়েছে। পাশাপাশি তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন সার্ভিসের নাম করে হাতানো হয়েছে টাকা। নিজের রেফারেন্সে লোক না আনতে পারলে চাপপ্রয়োগসহ নানা মানসিক চাপে অধিকাংশই কোর্স ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
এই চক্রের আরেকজন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী তন্ময় তানভীর। অভিযোগ রয়েছে তানভীরের মাধ্যমে যেসব শিক্ষার্থী ডিজিটাল মার্কেটিং কোর্সে ভর্তি হয়েছে তাদের কাছ থেকে নানা বাহানায় অর্থ আদায় করেছে। কোর্সের টাকা ফেরত চাইলে হুমকি-ধামকিসহ তাদেরকে ফেসবুকে ব্লক ও যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
এসব অভিযোগ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনায় আসার পর থেকে সাব্বির হাসান ও তন্ময় তানভীরের ফেসবুক আইডি ডিএক্টিভ ও মুঠোফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না।
এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল মামুন নিজেকেই ভুক্তভোগী দাবি করেন। তিনি বলেন, গতবছরের সেপ্টেম্বরে আমার বন্ধু সুমাইয়া আক্তার আশা ও খাদিমুল ইসলাম আসিফের কাছে ফ্রিল্যান্সিংয়ের বিষয়টি জানতে পেরে তাদের মাধ্যমে এখানে ভর্তি হই। ভর্তির পূর্বে কাজ শেখার পাশাপাশি তাদের প্রোডাক্ট সেলের কথা বলা হলেও ভর্তির পর সেটি হয়নি। এর মধ্যে আমার মাধ্যমে আরো তিনজন এই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়। অক্টোবরে জানতে পারি ৬ হাজার টাকা দিয়ে ভর্তি হওয়াটাই একটা কোর্স। অতিরিক্ত সময় এটার পেছনে যাওয়ায় আমি এই কোর্স বাদ দিয়ে গ্রামে চলে আসি।
অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে সিগনেচার মাইন্ড ইনস্টিটিউট নামে এই সংগঠনের এডমিন ম্যানেজার ইমরান হোসেন আকাশ বলেন, প্রতারণার বিষয়টি এখন পর্যন্ত কোনো শিক্ষার্থী আমাদের কাছে জানায়নি। প্রতিষ্ঠানের কেউ প্রতারণার শিকার হলে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে দ্রুত জানানো উচিত। আমাদের কাছে অভিযোগ দিলে সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নিব।
সার্বিক বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. মোস্তফা কামাল বলেন, ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের থানায় পাঠিয়েছি অভিযোগ দেয়ার জন্য। পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছি। বিষয়টি নিয়ে আমরা তৎপর। আর এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষার্থী জড়িত থাকার কথা উঠে আসছে তদন্ত সাপেক্ষে তাদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।ন জোবায়ের, জবি