গ্রাহকের সঙ্গে ভয়াবহ প্রতারণা করেছে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলেশা মার্ট। ৮ হাজারের বেশি মোটরসাইকেলের অর্ডার নিয়ে ডেলিভারি না দিয়ে গ্রাহকদের মাসের পর মাস ঘোরাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এর বাইরে বিভিন্ন ধরনের আরও ৫ হাজার পণ্যের অর্ডারের বেশিরভাগই আটকে রাখা হয়েছে। অথচ এসব পণ্যের অর্ডার দেওয়া গ্রাহকরা অগ্রিম টাকা পরিশোধ করেছেন আলেশা মার্টকে। শুধু মোটরসাইকেলের অর্ডার দেওয়া গ্রাহকের ১৪৬ কোটি টাকা আটকে রেখেছে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটি। জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। আলেশা মার্ট থেকে প্রতারিত হওয়া অসংখ্য গ্রাহক প্রতিকার চেয়ে অভিযোগ করেছেন ভোক্তা অধিদফতরে। গত মাসের ১৯ তারিখে ভোক্তা অধিদফতরে আলেশা মার্ট নিয়ে শুনানিও হয়। এ সময় প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকের পণ্য ডেলিভারি এবং যাদের রিফান্ড চেক দেওয়া হয় তাদের চেকের বিপরীতে অর্থ পরিশোধের জন্য সময় চেয়েছিল গত বছরের ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু প্রতিশ্রুতি রাখেননি আলেশা মার্ট। রিফান্ড চেক দিলেও সেটি দফায় দফায় বাউন্স হওয়ায় টাকা ফেরত পাচ্ছেন না গ্রাহকরা। এ অবস্থার মধ্যে মঙ্গলবার শত শত গ্রাহক ঘেরাও করেন বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ে অবস্থিত আলেশা মার্টের প্রধান কার্যালয়। এ সময় আলেশা মার্টের চেয়ারম্যান মো. মনজুর আলম শিকদারসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে ক্ষুব্ধ গ্রাহকরা মনজুর আলমকে তার কক্ষে ঘেরাও করেন। সন্ধ্যায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তিনি অবরুদ্ধ ছিলেন। এদিকে আলেশা মার্টের প্রতারণার বিষয়টি অইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরে এসেছে ইতোমধ্যেই। র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) পুরো পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে বলে জানা গেছে। র্যাবের একটি বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, আলেশা মার্টের চেয়ারম্যান মনজুর আলম শিকদারসহ প্রতিষ্ঠানটির বেশ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। হয়তো যেকোনো সময় মনজুর আলম শিকদারসহ অন্যরা গ্রেফতার হতে পারেন। ইতোমধ্যে আলেশা মার্টের ৪-৫ জন কর্মীকে আটক করা হয়েছে বলেও জানা গেছে। এ বিষয়ে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন সময়ের আলোকে বলেন, ‘আলেশা প্রধান কার্যালয়সহ তাদের কয়েকটি অফিস গ্রাহক ঘেরাও করেছে এমন তথ্য আমাদের কাছে আছে। তবে আলেশা মার্টের কাউকে র্যাব আটক করেনি বা তাদের অফিসে এখনও কোনো অভিযান পরিচালনা করেনি র্যাব। নজরদারির বিষয়টিও আমার জানা নেই।’ ভোক্তা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, আলেশা মার্টের প্রতারণার খবর জানার পর অধিদফতরের একটি টিম সম্প্রতি আলেশা মার্টের প্রধান কার্যালয়ে অভিযান চালায়। এ সময় ভোক্তা অধিদফতরের টিম বিভিন্ন বিভাগ ঘুরে দেখে এবং প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে। টিমের সদস্যরা আলেশা মার্টের ব্যবসার ধরন, অর্ডার ও পণ্য ডেলিভারি পরিস্থিতি কেমন- সব বিষয়ে জানতে চান। অভিযানে যাওয়া ভোক্তা অধিদফতরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সময়ের আলোকে বলেন, আলেশা মার্টের কার্যালয়ে অভিযান ও তাদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলার পর আমরা বেশ কিছু ঘাপলা দেখতে পেয়েছি। বিশেষ করে প্রতিষ্ঠানটি মোটরসাইকেলের অর্ডার নিয়ে বেশি প্রতারণা করেছে। ভোক্তা অধিদফতরের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, গেটওয়েতে আলেশা মার্টের ৪৬ কোটি টাকা জমা রয়েছে। ১৪৬ কোটি টাকার মোটরসাইকেলের অর্ডার নিয়েছিল আলেশা। ইভ্যালি সাধারণত সেইলারের থেকে এনে পণ্য দেয়। আলেশা মার্ট নিজেরা কিনে সাপ্লাই দেয়। প্রতিষ্ঠানটির ভাষ্য মতে, মোটরসাইকেল বিক্রির জন্য এখনও পর্যন্ত ৫টি ক্যাম্পেইন চালিয়েছে তারা। এর মধ্যে ৪টির সম্পূর্ণ অর্ডার ডেলিভারি দেওয়া সম্ভব হয়েছে। একটি ক্যাম্পেইনের অর্ডার বাকি আছে। বাজাজের হোন্ডা তারা ৩০ থেকে ৫০ শতংশ ডিসকাউন্টে বিক্রি করত। কিন্তু বাজাজ পঞ্চম ক্যাম্পেইনের হোন্ডা সাপ্লাই দেওয়া বন্ধ করে দেয়। বাজাজের পরিবেশক প্রতিষ্ঠানকে ১৫০ কোটি টাকা দেওয়া আছে আলেশা মার্টের পক্ষ থেকে। বাজাজ আবার কিউকম নামক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছে। এরপর থেকে তারা হোন্ডা সাপ্লাই দিচ্ছে না। টাকাও দিচ্ছে না এবং হোন্ডাও দিচ্ছে না। মূলত কাস্টমারের টাকা নিয়ে আলেশা মার্ট ১৫০ কোটি টাকা দিয়েছে বাজাজকে। বাজাজ সে টাকা বিনিয়োগ করেছে কিউকমে। এই অর্ডারগুলোর পুরোটাই ছিল মোটরসাইকেলের অর্ডার। পাঁচটি ক্যাম্পেইনের মধ্যে চারটিই ঠিকমতো ডেলিভারি দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করা হয় আলেশা মার্টের পক্ষ থেকে। পঞ্চম ক্যাম্পেইনে তারা ধরা খেয়েছে। পঞ্চম ক্যাম্পেইনে মোট অর্ডার আছে ৫ হাজারের ওপরে। এই ৫ হাজার অর্ডারে রয়েছে ১৩ হাজার পণ্য। এর মধ্যে মোটরসাইকেলের অর্ডার রয়েছে ৮ হাজার। তাদের ভাষ্য, এই ৮ হাজার অর্ডারের মধ্যে তিন ভাগের দুই ভাগ দেওয়া হয়ে গেছে। এক ভাগ দেওয়া যায়নি। অর্থাৎ প্রায় ২ হাজার ৬০০টির বেশি মোটরসাইকেল ডেলিভারি দিতে পারেনি আলেশা মার্ট। এর জন্য তিন মাস সময় চেয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আলেশা মার্টের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সে সময় দেয়। মন্ত্রণালয়ের দেওয়া সে সময়সীমা শেষ হয় গত ১৫ নভেম্বর। ভোক্তা অধিদফতরের পর্যবেক্ষণে আরও উঠে আসে, আলেশা মার্ট ই-কমার্স ব্যবসা শুরু করে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে। এর মালিকের অন্যান্য ব্যবসাও রয়েছে। ই-কমার্স নিয়ে যখন ঝামেলা সৃষ্টি হয় তখন আলেশা মার্টের সিসি লোনসহ সব ধরনের ঋণ দেওয়া বন্ধ করে দেয় ব্যাংকগুলো। ‘আমরা ব্যবসা করতে এসেছি, ফটকাবাজি করতে আসিনি’- ভোক্তা অধিদফতরের জেরার পরিপ্রেক্ষিতে আলেশা মার্টের চেয়ারম্যান এমন কথা বলেন বলে জানান ভোক্তার কর্মকর্তারা। তারা বলেন, আমরা জানতে চেয়েছিলাম, কীভাবে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ ডিসকাউন্টে ব্যবসা করেন আপনারা। এর সঠিক জবাব তারা দিতে পারেনি। তারপর আলেশা কার্ডেরও রমরমা বাণিজ্য করেছে তারা। আমরা এ কার্ড সম্পর্কেও জানতে চেয়েছিলাম। ৩ হাজার ৮০০ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছিল আলেশা মার্ট ওই কার্ডের মাধ্যমে ডিসকাউন্টে পণ্য বিক্রির জন্য। এর মধ্যে কাপড়ের দোকান, খাবার হোটেল, আবাসিক হোটেল, হাসপাতালসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আলেশা মার্টের ২৫টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ১১টি লাভজনক, বাকিগুলো লোকসানী প্রতিষ্ঠান। আলেশা মার্টের বিরুদ্ধে ৪৬টি অভিযোগ এসেছে ভোক্তা অধিদফতরে। এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যাদের পণ্য দিতে পারেনি, তাদের অনেককেই রিফান্ড চেক দেওয়া হয়েছে। ১০ নভেম্বর পর্যন্ত সময় নিয়ে চেক দেওয়া হয়েছিল। কারণ এ সময়ের মধ্যে আলেশা মার্ট ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার চেষ্টা করছিল, কিন্তু ঋণ না পাওয়ায় টাকা দিতে পারছে না। আমাদের কথা হলো, এতগুলো গ্রাহকের মোটরসাইকেলের টাকা নিয়ে দিনের পর দিন আটকে রাখতে পারে না। ভোক্তা অধিদফতরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ২০ অক্টোবর থেকে হোন্ডার ডেলিভারি দেওয়া শুরু করবে; কিন্তু সেটি আর তারা করেনি। যেহেতু তারা অর্ডার ডেলিভারি দেওয়া শুরু করেনি, তাই আমরাও তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাব। যা বলল আলেশা মার্ট কর্তৃপক্ষ : এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে মঙ্গলবার আলেশা মার্টের চেয়ারম্যান মো. মনজুর আলম শিকদারের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তবে প্রতিষ্ঠানটির হেড অব কমপ্লায়েন্স আশরাফুল হক সময়ের আলোকে বলেন, আমরা বেশিরভাগ অর্ডারের পণ্য সরবরাহ করেছি। মোটরসাইকেলের ডেলিভারিও প্রায় শেষ। কিছু গ্রাহকের চেক নিয়ে সমস্যা হয়েছে। সেগুলোও মেটানোর চেষ্টা করছি। অফিস ঘেরাওয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, কিছু গ্রাহক আমাদের অফিসে এসেছিলেন, আমরা তাদের বুঝিয়ে সময় চেয়েছি। তবে সার্বিক বিষয় নিয়ে আলেশা মার্টের পক্ষ থেকে আগামীকাল (আজ) বুধবার আমরা সংবাদ সম্মেলন করব। সেখানেই আমাদের সব বক্তব্য তুলে ধরব। |