এস এম আজাদ
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের নামে একটি গ্রুপ ও ৩৬টি ভুয়া আইডি শনাক্ত করে র্যাব। এমন তথ্য পেয়ে নতুন করে নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নামেও আইডি খুলে ফাঁদ পাতা হয়েছে এবং জানতে পেরে ফখরুল থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন।
পুলিশের সাইবার ক্রাইম তদন্তকারী সূত্র জানায়, নাট্যনির্মাতা রেদওয়ান রনির নামে ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলে অভিনয়ের কথা বলে টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল এক যুবক। অভিনেতা আরিফিন শুভর নামে আছে বেশ কিছু আইডি। একটি আইডি থেকে প্রতারণার অভিযোগ করেছেন ওই তারকা। একইভাবে কণ্ঠশিল্পী হাবিব ওয়াহিদ, হৃদয় খান, ইমরান, দিলশাদ নাহার কণা, নায়িকা মেহ্জাবীন চৌধুরী, মাহিয়া মাহি, পরীমণি, মৌসুমী, পূর্ণিমা, শাবনূর, রেসি, ববি, নায়ক শাকিব খান, রিয়াজ, ফেরদৌস, বাপ্পি, ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মর্তুজা, মেহেদী হাসান মিরাজ, মোস্তাফিজুরসহ জনপ্রিয় সব তারকার নামেই ভুয়া আইডি আছে।
মারুফ আহমেদ নামের এক ব্যক্তি জানান, নায়িকা কেয়ার নামে একটি ভুয়া আইডি থেকে তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে ৫০ হাজার টাকা কৌশলে হাতিয়ে নেয়। পরে সেই আইডিটি বন্ধ করা গেলেও প্রতারক নারীর নাগাল পাননি তিনি। তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, যেসব আইডি থেকে অসামাজিক কাজের প্রস্তাব দেওয়া হয় সেসব আইডির বেশির ভাগ তথ্যই ভুয়া, মানে আইডিটি ভুয়া। তবে অনেক সময় এর পেছনে সংঘবদ্ধ প্রতারকচক্রও থাকে। সুন্দরী নারী, তারকার ছবি ও অশালীন ছবি দেওয়া থাকে এসব আইডিতে। তাদের অনেকে নামের শেষে ‘আক্তার’ শব্দটি ব্যবহার করে।
গত শনিবার নিজের ফেসবুক আইডি থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করে একটি পোস্ট দেন রাজশাহীর এক নারী ইন্টার্ন চিকিৎসক। ‘আমার আইডি দিয়ে কেউ একজন ফেক আইডি খুলে সেই আইডিতে খারাপ খারাপ ছবি দিয়ে আপলোড করছে…।’ পরে যোগাযোগ করা হলে ওই মেডিক্যাল শিক্ষার্থী কালের কণ্ঠ’র কাছে স্বস্তির সঙ্গে জানান, ফেসবুকের কাছে রিপোর্ট করা হলে ফেক আইডিটি রিমুভ করা হয়েছে। তবে তাঁর ছবি যাচাই করে দেখা গেছে ‘মোরশেদ’ নামের আরেকটি আইডিতে তাঁর ছবি কাভার ছবি হিসেবেই আছে। শুধু তাই নয়, সেই আইডির ভেতরে আছে আরো কিছু তরুণীর ছবি।
জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে ছয়টি ও তাঁর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের নামে একটি অ্যাকাউন্ট খোলে ওমর ফারুক নামের এক ব্যক্তি। এসব আইডিতে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের ছবি দিয়ে নিজের নম্বর দেয় তিনি। অনেকে যোগাযোগের চেষ্টা করলে কৌশলে চ্যাটিংয়ে যায় সে। এরপর কাজের তদবিরের কথা বলে টাকা হাতিয়ে নেয়। একই কৌশলে স্পিকারসহ বিভিন্ন নেতাদের নামে ৩৬টি অ্যাকাউন্ট খোলে ফারুক। চার সহযোগীসহ গ্রেপ্তারের পর এখন ফারুককে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এক চাকরিজীবী মুহিত রহমান (ছদ্মনাম) ফেসবুকে কিছুদিন আগে ‘অনামিকা’ নামের সুন্দরী এক তরুণীকে বন্ধু করেন। কিছুদিন পর ওই ‘তরুণী’ অশালীন একটি ছবি পোস্ট করলে মুহিত বিস্মিত হন। একদিন ম্যাসেঞ্জারে ‘অনামিকা’ বলেন, ‘ইমো…করি। আগ্রহী হলে যোগাযোগ করেন। বিকাশে ৫০০ টাকা লাগবে।’ ঘটনা কী মুহিত জানতে চাইলে বলা হয়, ‘কাজ করলে বলেন। বিকাশ করেন। ফালতু পেচাল পারলে ব্লক করে দিব।’ কৌতূহলী হয়ে মুহিত ৩০০ টাকা বিকাশে পাঠান; এরপর তিনি ফোন করে দেখেন নম্বর বন্ধ, ফেসবুকে ঢুকে দেখেন তাঁকে ব্লক করে দিয়েছে ওই আইডি।
শাহিন নামের বাড্ডার আরেক যুবক জানান, ‘নওশিন লিজা’ নামের একটি আইডি থেকে সরাসরি অসামাজিক কাজের প্রস্তাব দেওয়া হয় তাঁকে। ইমো অ্যাপে বিশেষ কথা বলতে তাঁর কাছ থেকে এক হাজার টাকা বিকাশে নেওয়া হয়। এক নারীকণ্ঠের সঙ্গে কথাও বলেছেন শাহিন। একপর্যায় তিনি দেখা করার কথা বললে ব্লক করে দেওয়া হয়।
নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়ে বনানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রবিন হোসেন (ছদ্মনাম) বলেন, ‘মেঘা চৌধুরী’ নামের একটি আইডি থেকে বনশ্রীতে অসামাজিক কাজের জন্য বাসার ঠিকানা দিয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে ফেসবুকে। সম্প্রতি বোনের সামনে ফেসবুকের ওয়ালে এমন পোস্ট দেখে তিনি বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যান। রবিন জানান, এমন আরো কিছু আইডি তিনি পেয়েছেন।
গত সপ্তাহে তৌফিক রহমান নামের এক ব্যক্তি ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে বলেন, ‘আমার আইডি থেকে টাকা চাইলে কেউ দিবেন না। আইডি হ্যাকড।’ পরে তিনি বলেন, আইডি রিমুভ করা গেছে। তবে প্রযুক্তিগত ভুলে তিনি উদ্ধার আর করতে পারেননি।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানিয়েছে, ফেসবুকের অপরাধ নিয়ে তদন্তের সক্ষমতা বাড়ছে। তবে ফেসবুকের সঙ্গে সরাসরি কাজ করে এমন একক কোনো সংস্থা নেই পুলিশ প্রশাসনে। এ ব্যাপারে কোনো সমন্বিত তথ্যও নেই। জানতে চাইলে সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি, মিডিয়া) সোহেল রানা বলেন, ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার ইউনিট, পুলিশ সদর দপ্তরের এলআইসি সেল, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), বিশেষ শাখা (এসবি) ও র্যাব সাইবার ক্রাইম নিয়ে আলাদাভাবে কাজ করছে।
এদিকে র্যাব ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে প্যাট্রলিংয়ের জন্য ‘সাইবার নিউজ ভেরিফিকেশন সেন্টার’ চালু করেছে। সেখানে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালানো হয় বলে জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান। তিনি বলেন, ‘অভিযোগ পেলে আমরা দ্রুত পদক্ষেপ নিচ্ছি।’
ফেসবুকের সবচেয়ে বেশি অভিযোগ সিটিটিসির সাইবার ক্রাইম ইউনিটে। গত এক বছরে এক হাজার ৬৭০টি অভিযোগ এসেছে সেখানে। দুই শতাধিক আইডির বিরুদ্ধে ২০৪ মামলার তদন্ত চলছে। অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) নাজমুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, অভিযোগ পেলে নির্দিষ্ট চ্যানেলে তদন্ত হয়। ফেসবুকের সঙ্গে সরাসরি তথ্য আদান-প্রদান করেও তদন্ত চলছে বলে জানান তিনি।
রত্না রহমান (ছদ্মনাম) নামের এক চাকরিজীবী তরুণী বলেন, তাঁর নামে আইডি খুলে সেখানে নগ্ন ছবি দেওয়া হয়। এসব লিংকও তাঁকে পাঠিয়ে ২০ হাজার টাকা দাবি করা হয়। একপর্যায়ে তিনি ১৫ হাজার টাকা দিয়ে ওই কর্মকাণ্ড বন্ধ করেন। পুলিশের কাছে গেলে ফের করা হতে পারে—এ ভয়ে তিনি যাননি। তবে এখনো তাঁর ছবি দিয়ে দুটি আইডি চলছে বলে জানান রত্না।
গত বছর ‘সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের এক গবেষণায় উঠে আসে, দেশে সাইবার অপরাধের শিকার ৫১.১৩ শতাংশ নারী এবং ৪৮.৮৭ শতাংশ পুরুষ। গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ভুয়া আইডির মাধ্যমে হয়রানির শিকার হন ১৪.২৯ শতাংশ নারী এবং ১২.৭৮ শতাংশ পুরুষ। ছবি বিকৃতির শিকার হন ১২.৩ শতাংশ নারী এবং ৩.৭৬ শতাংশ পুরুষ। অনলাইনে হুমকির শিকার ৯.৭ শতাংশ নারী এবং পুরুষ ৩.৭৬ শতাংশ। গবেষণায় উঠে আসে, ভুক্তভোগী অনেকেই আত্মমর্যাদা ধরে রাখতে ঘটনা চেপে যান। যাঁরা অভিযোগ করেন তাঁদের মধ্যে হাতে গোনা ব্যক্তি সুফল পেয়েছেন। অভিযোগ করার কারণে অনেকে হয়রানির মুখেও পড়েছেন। তথ্য ও যোগাযোগ খাতে গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের (বিডিওএসএন) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫৬ লাখ। এর মধ্যে ১১ লাখই ভুয়া। ২০১৭ সালের একটি জরিপ থেকে জানা যায়, সক্রিয় ফেসবুক ব্যবহারকারীর তালিকায় ঢাকা বিশ্বে দ্বিতীয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তারকাদের ফেসবুক আইডি ‘ভেরিফায়েড’ হলে তাতে ‘ব্যাজ’ দেওয়া থাকে। ভুয়া আইডিতে ব্যাজ থাকে না, থাকে বহুল ব্যবহৃত পুরনো ছবি, অন্য আইডি বা পেজের ছবি। তারকাদের ওয়ালে হালনাগাদ তথ্য না থাকলেও সেটি ভুয়া আইডি হওয়ার আশঙ্কা আছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইডির ‘অ্যাবাউট’ অপশনে গিয়ে ই-মেইল বা অন্য যোগাযোগ, ঠিকানা, ফ্যামিলি ফ্রেন্ড এবং শিক্ষাগত যোগ্যাতার সূত্র থেকেও আইডি সঠিক কি না তা সহজে বোঝা যায়। ভুয়া আইডিতে এসব থাকে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভুয়া আইডির ব্যাপারে ফেসবুকেই রিপোর্ট করারও সুযোগ আছে।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক উমর ফারুক বলেন, প্রযুক্তিকে প্রযুক্তি দিয়ে মোকাবেলা করতে হবে। আইসিটি আইনের পরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনও হয়েছে। এখন দরকার প্রয়োগ।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের সাইবার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলো আন্তর্জাতিক ৭৪টি গেটওয়ে বাদ দিয়ে বাইরের গেটওয়ে সলিউশন ব্যবহার করে। এতে অনেক ফাঁক থাকে। বিটিআরসির গেটওয়েগুলো ব্যাবহার করলে নজরদারি জোরালো হবে। এ ছাড়া আইপি ও ডিভাইসগুলোও নিবন্ধিত নয়।’ তিনি আরো বলেন, পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটে প্রশিক্ষিত দক্ষ জনবল বাড়াতে হবে। এখানে ঘাটতি আছে। এ কারণে যত লোক ধরা পড়ছে তারা জামিনে ছাড়া পেয়ে যায়। জামিন অযোগ্য অভিযোগেও জামিন হয়। কারণ আদালতে প্রযুক্তিগতভাবে প্রমাণ করা যাচ্ছে না।
পুলিশসহ তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ বেড়েছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী কাজ করতে কয়েকটি তদন্ত ইউনিট গঠন করা হয়েছে। তবে ভুক্তভোগীদের ভাষ্য, এমপি-মন্ত্রীদের অভিযোগ পেলে যত দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়, সাধারণ মানুষের অভিযোগ সেভাবে পাত্তা পাচ্ছে না। তাঁরা আরো বলছেন, ভুয়া আইডির নামে ফেসবুক ও বিটিআরসি কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট ও অভিযোগ করেও প্রতিকার পাচ্ছেন না তাঁরা। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ভুয়া ও বাজে আইডি বন্ধ এবং ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ফেসবুক বললেও বাস্তবে এসব অভিযোগ আমলেই নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ।