সারাদেশের ৩০০ আসনের মধ্যে ৭৯ আসনে একজনও স্বতন্ত্র প্রার্থী নেই। যদিও বিএনপিহীন এই ভোটে সবচেয়ে বেশি আলোচিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। বাকি ২২১ আসনে লড়ছেন ৩৮২ স্বতন্ত্র প্রার্থী।
স্বতন্ত্র প্রার্থীশূন্য ৭৯ আসনের বেশির ভাগেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ‘হেভিওয়েট’ নেতারা প্রার্থী হয়েছেন। তবে অধিকাংশ স্থানে ‘কিংস পার্টি’খ্যাত তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন) ও বিএসপি (বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি) মনোনীতরা প্রার্থী হয়েছেন।
গত দুই সংসদ নির্বাচনে ‘বিনা ভোটে জয়ী’ ও ‘ভোট কারচুপি’র অভিযোগ তুলে রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি এবং তাদের মিত্ররা সরকারবিরোধী আন্দোলনে রয়েছে। বিরোধীদের এসব সমালোচনার জবাব দিতে সরকার এবার নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক এবং ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিত করতে নানা কৌশল ব্যবহার করছে। এরই অংশ হিসেবে নিজ দলের মনোনয়নবঞ্চিতদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে উৎসাহিত করছে ক্ষমতাসীনরা।
বিএনপি ও তাদের মিত্রদের বর্জন সত্ত্বেও এ নির্বাচনে নিবন্ধিত ২৭টি রাজনৈতিক দল প্রার্থী দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকায় দেখা গেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনোনীতরা রয়েছেন ২৬৩ আসনে। পরবর্তী সময়ে তিনটি আসনে এই দলের তিনজন আদালতের রায়ে প্রার্থিতা ফেরত পেয়েছেন। এখন তারা ২৬৬ আসনে লড়াইয়ে আছেন। সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির প্রার্থী রয়েছেন ২৬৫ আসনে। যদিও আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন বণ্টনের সমঝোতায় তারা মূলত লড়ছেন ২৬টি আসনে।
এই নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার আগ থেকেই ব্যাপক আলোচিত তিন নতুন দল মিলেও ৩০০ আসনের সবক’টিতে প্রার্থী দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ইসির হিসাব অনুযায়ী তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী রয়েছে ১৩৩ আসনে। বিএনএম ৫৪ আসনে এবং বিএসপি ৭৯ আসনে প্রার্থী দিয়েছে। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া ৩৮২ জনের মধ্যে অধিকাংশই আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত বা স্থানীয় আওয়ামী লীগের পদধারী নেতা। ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে শুরু থেকেই এদের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ করছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা। নির্বাচন প্রক্রিয়ার শুরুতে কিংস পার্টির তিন দলের যে কেউ অথবা জাতীয় পার্টি বিরোধী দলের আসনে বসবে– এমন ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পর স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জোট গঠনের মাধ্যমে বিরোধী দলের আসনে বসতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০১৪ সালে দশম সংসদে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জোট গঠন করেছিলেন। এবার প্রতীক বরাদ্দের সময়ই তাদের মধ্যে এক ধরনের সমন্বয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অনেক স্থানেই আওয়ামী লীগের পদধারী স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ‘ঈগল’ ও ‘ট্রাক’ প্রতীক বেছে নিয়েছেন।
ইসি সূত্র জানায়, অতীতের নির্বাচনগুলোর মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী সবচেয়ে বেশি ছিল ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। ওই নির্বাচনে ৪৮৬ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। এর মধ্যে ছয়জন জিতেছিলেন। তবে এবারের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে অন্তত ২৮ জন বর্তমান সংসদের এমপি এবং বেশ কয়েকজন সাবেক এমপি রয়েছেন।
ইসি সূত্র জানায়, স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। কারণ, রিটার্নিং কর্মকর্তার বাছাই ও ইসির আপিলে বাদ পড়া অনেকেই উচ্চ আদালতে রিট করেছেন। তাদের কেউ কেউ ইতোমধ্যে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন। ভোটের আগ পর্যন্ত আরও কেউ প্রার্থিতা ফিরে পেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এবার তুলনামূলক স্বতন্ত্র প্রার্থী বেশি বগুড়ায়। এই জেলার সাতটি আসনের ছয়টিতে স্বতন্ত্র আছেন মোট ১৮ জন। এর মধ্যে বগুড়া-১ ও ৩ আসনে চারজন করে স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন।
আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ। এর আগে ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় পেয়েছিল আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্ররা। তখন এটি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা তৈরি হয়েছিল। এবার যাতে কেউ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী না হন, সেদিকে সতর্ক ছিল আওয়ামী লীগ। এবার কেউ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় পাননি।
ইসির তথ্য অনুযায়ী, এবারের নির্বাচনে ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি) ১২২ আসনে প্রার্থী দিয়েছে। তবে রাজনীতি বা ভোটের মাঠে এই দলের তেমন কোনো প্রভাব নেই। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের মধ্যে জাসদ ৬৪ আসনে, ওয়ার্কার্স পার্টি ২৬, তরীকত ফেডারেশন ৩৮, জেপি ১৩ এবং সাম্যবাদী দল চারটি আসনে প্রার্থী দিয়েছে।
এর বাইরে অন্য দলগুলোর মধ্যে ইসলামী ফ্রন্ট ৩৯ আসনে, ইসলামী ঐক্যজোট ৪২, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ২৯, গণফোরাম ৯, গণফ্রন্ট ২১, জাকের পার্টি ২১, বিকল্পধারা ১০, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট ৩৭, বাংলাদেশ কংগ্রেস ৯৫, কল্যাণ পার্টি ১৬, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ১১, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি ৫, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ৫, বিএনএফ ৪৫, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ ৪ এবং সাংস্কৃতিক মুক্তি জোট ৬৩ আসনে প্রার্থী দিয়েছে। সব মিলে এবার মোট বৈধ প্রার্থীর সংখ্যা ১ হাজার ৮৯৫ জন।
নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই দলগুলোর কোনোটিই আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলার সামর্থ্য রাখে না। তবে এবারে নির্বাচনের নতুনত্ব হচ্ছে দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী। শতাধিক আসনে এই স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নিজ দলের নৌকার প্রার্থীদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারেন। আওয়ামী লীগের বর্তমান ২৮ জন সংসদ সদস্য দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আছেন। জেলা ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং পৌরসভার মেয়র পদ ছেড়ে স্বতন্ত্র হিসেবে লড়ছেন ৩৫ জন। তাদের বাইরে সাবেক সংসদ সদস্য এবং স্থানীয় রাজনীতিতে প্রভাবশালী আরও অনেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।