আন্তর্জাতিক ডেস্ক
চলতি বছরের সর্বশেষ হেনলি পাসপোর্ট সূচকে ভারতের পাসপোর্ট শক্তি পাঁচ ধাপ কমে ৮৫তম স্থানে নেমে এসেছে। ভিসা-মুক্ত ভ্রমণের ওপর ভিত্তি করে বিশ্বের ১৯৯টি দেশের পাসপোর্ট র্যাংকিং প্রকাশ করে যুক্তরাজ্যভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত এখন ৫৭টি দেশে ভিসা-মুক্ত বা অন-অ্যারাইভাল সুবিধা পাচ্ছে, যা আফ্রিকার দেশ মৌরিতানিয়ার সমান।
বিশ্লেষকদের মতে, এ অবস্থান ভারতের জন্য হতাশাজনক, কারণ অনেক ছোট অর্থনীতির দেশ যেমন রুয়ান্ডা (৭৮তম), ঘানা (৭৪তম) এবং আজারবাইজান (৭২তম) ভারতের ওপরে অবস্থান করছে। গত এক দশকে ভারতের অবস্থান ওঠানামা করলেও সামগ্রিকভাবে স্থিতিশীল উন্নতি দেখা যায়নি। ২০১৫ সালে ভারতের অবস্থান ছিল ৮৫তম এবং সে বছর ৫২টি দেশে ভিসা-মুক্ত ভ্রমণ করা যেত। ২০২৫ সালে দেশটির গন্তব্য বেড়ে ৫৭টি হলেও র্যাংক অপরিবর্তিত রয়েছে।
বিশ্বব্যাপী গড় হিসেবে বর্তমানে একজন নাগরিক প্রায় ১০৯টি দেশে ভিসা-মুক্ত ভ্রমণের সুযোগ পাচ্ছেন, যা ২০০৬ সালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। ফলে ভারতের তুলনামূলক অগ্রগতি সীমিত বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। উদাহরণস্বরূপ, চীন গত এক দশকে তাদের নাগরিকদের ভিসামুক্ত গন্তব্য ৫০ থেকে বাড়িয়ে ৮২ করেছে এবং এর ফলে র্যাংক ৯৪তম থেকে উন্নীত হয়ে ৬০তম স্থানে পৌঁছেছে।
হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্সের তথ্য অনুযায়ী, ভারত জুলাই ২০২৫-এর সূচকে ৭৭তম স্থানে ছিল, তখন দেশটির নাগরিকরা ৫৯টি দেশে ভিসা-মুক্তভাবে প্রবেশ করতে পারতেন। তবে অক্টোবরে দুটি দেশের ভিসামুক্ত সুবিধা হারানোর পর ভারতের অবস্থান নেমে গেছে ৮৫তম স্থানে।
এ বিষয়ে ভারত সরকার কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করেনি। তবে ভারতের সাবেক কূটনীতিক আচল মালহোত্রা মনে করেন, একটি দেশের পাসপোর্টের শক্তি নির্ভর করে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর নয়; রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, কূটনৈতিক সম্পর্ক, অভিবাসন নীতি এবং নাগরিকদের বৈশ্বিক আচরণের মতো বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তিনি বলেন, “অনেক দেশ এখন অভিবাসন নিয়ে আরও সতর্ক হচ্ছে। ভারত থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ বিদেশে যায় এবং অনেকেই ভিসার মেয়াদ শেষ হলেও অবস্থান অব্যাহত রাখে, যা দেশের ভাবমূর্তিকে প্রভাবিত করে।”
মালহোত্রা আরও বলেন, পাসপোর্টের নিরাপত্তা বৈশ্বিক আস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত। ২০২৪ সালে দিল্লি পুলিশ ভিসা ও পাসপোর্ট জালিয়াতির অভিযোগে ২০৩ জনকে গ্রেপ্তার করে। এ ধরনের ঘটনা ভারতীয় পাসপোর্টের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ায়। পাশাপাশি, ভারতের অভিবাসন প্রক্রিয়ার জটিলতা ও ভিসা অনুমোদনের ধীরগতি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের ইমেজকে প্রভাবিত করছে।
তিনি আশা প্রকাশ করেন, নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার এই পরিস্থিতি উন্নত করতে পারে। সম্প্রতি চালু হওয়া ভারতের ই-পাসপোর্ট ব্যবস্থা এতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। ই-পাসপোর্টে সংযুক্ত বায়োমেট্রিক চিপ জালিয়াতি রোধে কার্যকর এবং প্রক্রিয়া সহজতর করতে সক্ষম। তবে মালহোত্রার মতে, ভারতের পাসপোর্টের অবস্থান উন্নত করতে মূলত প্রয়োজন কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করা, ভ্রমণ চুক্তি বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক আস্থা পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা।
বর্তমানে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সিঙ্গাপুর ১৯৩টি দেশে ভিসা-মুক্ত প্রবেশাধিকারের মাধ্যমে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে। দক্ষিণ কোরিয়া ১৯০টি দেশে ভিসা-মুক্ত সুবিধা নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে এবং জাপান ১৮৯টি দেশে প্রবেশাধিকার নিয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ইতিহাসে প্রথমবারের মতো শীর্ষ ১০ থেকে বাদ পড়ে ১২তম স্থানে নেমে এসেছে, যা বিশ্লেষকদের মতে, বৈশ্বিক রাজনীতিতে দেশটির ক্রমবর্ধমান একঘরে অবস্থানকে নির্দেশ করে।
হেনলি সূচক অনুযায়ী, পাসপোর্টের শক্তি শুধু ভ্রমণ নয়, বরং একটি দেশের বৈশ্বিক প্রভাব, ব্যবসায়িক সুযোগ, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভারতের জন্য বর্তমান র্যাংকিং একটি সতর্কবার্তা—বিশ্ব অর্থনীতি ও কূটনীতির প্রতিযোগিতামূলক বাস্তবতায় পিছিয়ে পড়া ঠেকাতে দেশের নীতি ও কৌশলে পরিবর্তন আনতে হবে।