অর্থনীতি ডেস্ক
২০২৬ সালে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম ছয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে নেমে আসবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। দুর্বল বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, তেলের উদ্বৃত্ত সরবরাহ এবং নীতিগত অনিশ্চয়তার কারণে টানা চতুর্থ বছরের মতো পণ্যের দাম কমবে বলে সংস্থাটির ‘কমোডিটি মার্কেটস আউটলুক অক্টোবর ২০২৫’ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫ ও ২০২৬ সালে পণ্যের দাম গড়ে ৭ শতাংশ হ্রাস পাবে। অপরিশোধিত তেলের দাম ২০২৫ সালের গড় ৬৮ ডলার থেকে ২০২৬ সালে ব্যারেলপ্রতি ৬০ ডলারে নেমে আসার সম্ভাবনা রয়েছে, যা গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। চীনে তেলের ব্যবহার স্থিতিশীল থাকায় বৈশ্বিক বাজারে তেলের অস্থিরতা উল্লেখযোগ্যভাবে কম থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তেলের দামে এই পতন কৃষি ও খাদ্যপণ্যের বাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
বিশ্বব্যাংক জানায়, বৈশ্বিক পণ্যমূল্যের নির্ধারণে জ্বালানি খাত অন্যতম প্রভাবক। ২০২৫ সালে জ্বালানির দাম আগের বছরের তুলনায় ১২ শতাংশ এবং ২০২৬ সালে আরও ১০ শতাংশ কমবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। তবে ২০২৭ সালে দাম কিছুটা বাড়তে পারে, যা প্রায় ৬ শতাংশ বৃদ্ধির সমান।
২০২৫ সালের শুরু থেকেই বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্যের পতন শুরু হয়েছে। এর পেছনে জ্বালানি তেলের দাম কমার পাশাপাশি চীনে তেলের চাহিদা হ্রাস এবং বিশ্ববাজারে সরবরাহ বৃদ্ধিকে মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি। জ্বালানির দাম কমায় বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস পাচ্ছে, পাশাপাশি চাল ও গমের দাম কমে যাওয়ায় অনেক উন্নয়নশীল দেশে খাদ্য আরও সাশ্রয়ী হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ইন্দ্রমিত গিল বলেন, “জ্বালানি তেলের দামের পতন বিশ্বব্যাপী ভোক্তা-মূল্য মুদ্রাস্ফীতি কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তবে এই স্বস্তি দীর্ঘস্থায়ী নাও হতে পারে। সরকারগুলোর উচিত বর্তমান সুযোগ কাজে লাগিয়ে আর্থিক খাতকে সুশৃঙ্খল করা এবং বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণে মনোযোগ দেওয়া।”
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈদ্যুতিক ও হাইব্রিড যানবাহনের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা এবং চীনে তেলের ব্যবহার স্থবির হয়ে পড়ায় তেলের চাহিদা আরও ধীরগতিতে কমবে। এর ফলে ২০২৬ সাল নাগাদ বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে স্থিতিশীলতা আসবে।
খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রেও মূল্য হ্রাসের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ২০২৫ সালে খাদ্যের দাম ৬ দশমিক ১ শতাংশ এবং ২০২৬ সালে ০ দশমিক ৩ শতাংশ কমার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। রেকর্ড উৎপাদন ও বাণিজ্যিক অস্থিরতার কারণে ২০২৫ সালে সয়াবিনের দাম কমলেও আগামী দুই বছরে তা স্থিতিশীল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
একই সময়ে সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতির কারণে ২০২৬ সালে কফি ও কোকোর দাম হ্রাস পেতে পারে। তবে বাণিজ্য সীমাবদ্ধতার প্রভাবে ২০২৫ সালে সারের দাম ২১ শতাংশ বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা কৃষকদের লাভের পরিমাণ কমিয়ে দিতে পারে এবং ভবিষ্যৎ ফসল উৎপাদন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে।
মূল্যবান ধাতুর বাজারে বিপরীত চিত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে নিরাপদ সম্পদের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে ২০২৫ সালে সোনার দাম ৪২ শতাংশ এবং ২০২৬ সালে আরও ৫ শতাংশ বাড়তে পারে। রূপার দামও ২০২৫ সালে ৩৪ শতাংশ ও ২০২৬ সালে ৮ শতাংশ বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।
বিশ্বব্যাংক সতর্ক করেছে, বৈশ্বিক বাণিজ্য উত্তেজনা ও নীতিগত অনিশ্চয়তা অব্যাহত থাকলে পণ্যমূল্য প্রত্যাশার চেয়ে আরও দ্রুত হ্রাস পেতে পারে। অন্যদিকে ভূ-রাজনৈতিক সংঘাত বা অতিরিক্ত নিষেধাজ্ঞা তেলের দাম বাড়িয়ে দিতে পারে এবং সোনা ও রুপার মতো নিরাপদ বিনিয়োগ পণ্যের চাহিদা বাড়িয়ে তুলতে পারে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্রুত বিস্তার ও বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে শক্তি ব্যবহারের চাহিদা বৃদ্ধির ফলে অ্যালুমিনিয়াম ও তামার মতো ধাতুর দাম বাড়তে পারে।
বিশ্বব্যাংকের উপ-প্রধান অর্থনীতিবিদ আয়হান কোস বলেন, “তেলের দাম কমলে উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়। ব্যয়বহুল জ্বালানি ভর্তুকি অবকাঠামো ও মানবসম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগে ব্যবহার করা গেলে তা দীর্ঘমেয়াদে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করবে এবং টেকসই কর্মসংস্থান নিশ্চিত করবে।”