আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও ইসরায়েলি অবরোধে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় মানবিক সংকট অব্যাহত রয়েছে। খাদ্য, চিকিৎসা ও আশ্রয়ের তীব্র অভাবের পাশাপাশি শীতের আগমনে বিপর্যস্ত জীবনে যুক্ত হয়েছে নতুন দুর্ভোগ। গাজা এখন এক মানবিক বিপর্যয়ের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সোমবার (৩ নভেম্বর) আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরও ইসরায়েলের হামলা পুরোপুরি থামেনি। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, গত এক মাসে অন্তত ২৩৬ ফিলিস্তিনি নিহত এবং ৬০০ জনের বেশি আহত হয়েছেন।
গত ২৪ ঘণ্টায় গাজার বিভিন্ন স্থানে তিনজনের মৃত্যু ও ধসে পড়া ভবনের ধ্বংসস্তূপ থেকে আরও তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। নিহতদের মধ্যে একজন আগের হামলায় আহত হয়ে মারা যান।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি শুরুর পর থেকে ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে ৫০০ জন ফিলিস্তিনির মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এরা সবাই গত দুই বছরের টানা বোমাবর্ষণ ও ধ্বংসযজ্ঞের শিকার।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর রোববার জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক রেডক্রসের মাধ্যমে তিনজন ইসরায়েলি বন্দির মরদেহ ফেরত আনা হয়েছে। যুদ্ধবিরতির শর্ত অনুযায়ী, প্রতিটি ইসরায়েলি বন্দির মরদেহের বিনিময়ে ইসরায়েলকে ১৫ জন মৃত ফিলিস্তিনি বন্দির মরদেহ ফেরত দিতে হবে।
মার্কিন সামরিক বাহিনীর সেন্ট্রাল কমান্ড (সেন্টকম) অভিযোগ করেছে, হামাস দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসে একটি ত্রাণবাহী ট্রাক লুট করেছে। তবে সংস্থাটি এ সংক্রান্ত কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করেনি। ড্রোন ফুটেজের বরাত দিয়ে দাবি করা হয়, “হামাস সদস্যরা” মানবিক সহায়তা দখল করেছে।
গাজার সরকারি গণমাধ্যম কার্যালয় এই অভিযোগ অস্বীকার করে জানায়, এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও সাজানো। তাদের দাবি, ইসরায়েল ইচ্ছাকৃতভাবে সহায়তা সরবরাহে বাধা দিচ্ছে, যাতে ক্ষুধা ও মানবিক সংকট তৈরি হয় এবং আন্তর্জাতিক মহলে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা চালানো যায়।
ইসরায়েলি অবরোধের কারণে গাজার হাসপাতালগুলো ভয়াবহ সংকটে পড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)-এর তথ্য অনুযায়ী, ১৬ হাজার ৫০০ জনেরও বেশি রোগী বর্তমানে বিশেষায়িত চিকিৎসার প্রয়োজন নিয়ে গাজায় আটকা রয়েছেন।
জাতিসংঘের এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মিসর ৪ হাজার আহত ফিলিস্তিনিকে চিকিৎসার জন্য গ্রহণ করেছে, সংযুক্ত আরব আমিরাত ১ হাজার ৪৫০ জন, কাতার ৯৭০ জন, তুরস্ক ৪৩৭ জন এবং ইতালি ২০১ জনকে চিকিৎসা দিয়েছে। তবে এখনো প্রায় ৩ হাজার ৮০০ শিশুসহ বহু মানুষ বিদেশে চিকিৎসার অপেক্ষায় আছেন।
শীত ঘনিয়ে আসায় বাস্তুচ্যুত মানুষরা গাজায় টিকে থাকার শেষ চেষ্টা করছেন। ইসরায়েল নির্মাণসামগ্রী প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় অনেকে কাদা ও ধ্বংসস্তূপের ইট দিয়ে অস্থায়ী আশ্রয় তৈরি করছেন।
গাজা সিটির বাসিন্দা খালেদ আল-দাহদুহ বলেন, “শীত আসছে, তাই কিছুটা আশ্রয় তৈরি করার চেষ্টা করেছি। তাঁবু নেই, সিমেন্ট নেই— তাই ধ্বংসস্তূপের ইট আর কাদা দিয়ে ঘর বানিয়েছি, অন্তত ঠান্ডা আর বৃষ্টি থেকে কিছুটা রক্ষা পাওয়া যায়।”
তার আত্মীয় সাইফ আল-বায়েক জানান, উপকরণ না থাকায় তার ঘর সম্পূর্ণ করা সম্ভব হয়নি। “পুরো এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে,” বলেন তিনি। “ফাঁকফোকর দিয়ে পানি ঢোকে, ছাদ অসমান— বেঁচে থাকার জন্য এটুকুই ভরসা।”
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)-এর গাজা প্রতিনিধি আলেসান্দ্রো ম্রাকিচ বলেন, “নির্মাণসামগ্রীর অভাবে মানুষ প্রাচীন পদ্ধতিতে আশ্রয় নির্মাণ করছে। এটি তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়।”
সহায়তা সংস্থাগুলো সতর্ক করেছে, তাপমাত্রা আরও কমতে থাকলে গাজার পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার নিতে পারে। যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকলেও ক্ষুধা, ঠান্ডা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে গাজার মানুষ এখনো মৃত্যুভয়ে দিন পার করছেন।