খেলাধুলা ডেস্ক
ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনাল শেষে মুম্বাইয়ের ডিওয়াই পাটিল স্টেডিয়ামের এক প্রান্তে ছিল ভারতের শিরোপা উৎসব, অন্য প্রান্তে নেমে এসেছিল নীরবতা। দক্ষিণ আফ্রিকার ডাগআউটে তখন হতাশার ছায়া। সম্ভবত নিজের শেষ ওয়ানডে বিশ্বকাপে নামা মারিজান কাপের চোখে অশ্রু, অধিনায়ক লরা উলভার্ডট ও অলরাউন্ডার নাদিন দে ক্লার্কের মুখে ছিল অবিশ্বাসের ছাপ। টাজমিন ব্রিটস একা বসে যেন ভাবছিলেন, ‘আর একটু পারলেই ইতিহাস লেখা যেত।’
একেকটি ফাইনাল, একেকটি স্বপ্নভঙ্গ—এই দৃশ্য যেন দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট ইতিহাসে অভিশাপের মতো লেগে আছে। পুরুষ কিংবা নারী দল—দুজনই বারবার শেষ মুহূর্তে এসে হোঁচট খাওয়ার গল্প লিখেছে। ২০২৩ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নিজেদের ঘরের মাঠে প্রথমবারের মতো ফাইনালে উঠেও রানার্স-আপ হয় দক্ষিণ আফ্রিকা নারী দল। এবার আরও অভিজ্ঞ ও ভারসাম্যপূর্ণ দল নিয়ে তারা পৌঁছেছিল ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে। সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে শিরোপা লড়াইয়ে ভারতকে কঠিন চ্যালেঞ্জও ছুড়ে দিয়েছিল তারা। তবে শেষ পর্যন্ত ভাগ্য সহায় হয়নি, আবারও হারতে হয়েছে শিরোপার দৌড়ে।
বিশ্বকাপের ইতিহাসে দক্ষিণ আফ্রিকা দলকে প্রায়ই ‘চোকার্স’ হিসেবে অভিহিত করা হয়—শেষ মুহূর্তে জয়ের কাছাকাছি এসে ব্যর্থ হওয়ার জন্য। তবে এবারের আসরে তাদের পারফরম্যান্সে সেই তকমা কিছুটা ম্লান হয়েছে। পুরো টুর্নামেন্টে দলটি ধারাবাহিকতা দেখিয়েছে, একসময় টানা পাঁচ ম্যাচে জয় পেয়েছে। ফাইনালে তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ক্রিকেট খেললেও ভারতের বিপক্ষে শেষ পর্যন্ত জয় ধরা দেয়নি।
দলের নেতৃত্বে থাকা লরা উলভার্ডটের পারফরম্যান্স এবারের আসরে ছিল ব্যতিক্রমী। তিনি টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক এবং ওয়ানডে বিশ্বকাপের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান করা ক্রিকেটার। সেমিফাইনাল ও ফাইনাল—দুটি ম্যাচেই টানা সেঞ্চুরি করেন তিনি। পুরো আসরে আটটি ক্যাচ নিয়ে ফিল্ডিংয়েও ছিলেন অনন্য। সব মিলিয়ে এটি ছিল তার ব্যক্তিগতভাবে এক অসাধারণ টুর্নামেন্ট, যদিও ট্রফি ওঠেনি তার হাতে।
ম্যাচশেষে উলভার্ডট বলেন, “ভারত আমাদের চেয়ে ভালো খেলেছে, তবে এই টুর্নামেন্টে আমরা দারুণ ক্রিকেট খেলেছি। একসময় টানা পাঁচ ম্যাচ জিতেছিলাম, যা দলের জন্য বড় অর্জন। ধারাবাহিকতা বজায় রাখা এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।”
তিনি আরও যোগ করেন, “পুরো টুর্নামেন্টে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন খেলোয়াড় এগিয়ে এসেছে। উপমহাদেশের কন্ডিশনে স্পিনের বিপক্ষে আমরা ভালো খেলেছি, পেসাররাও অসাধারণ করেছে। কাপ ও নাদিন দে ক্লার্ক দুজনই দলের সাফল্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।”
দলের কোচ মান্ডলা মাশিম্বিয়ি মাত্র ১০ মাস ধরে দায়িত্বে আছেন। তিনি বলেন, “আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দলের উন্নতি দেখে গর্ববোধ করছি। যখন কেউ আমাদের সুযোগ দেয়নি, তখন আমরা নিজেরাই নিজেদের ওপর বিশ্বাস রেখেছি। ফাইনালে পৌঁছানোই প্রমাণ করে, আমরা এগোচ্ছি।”
বিশ্বকাপের আগে এক বছরে ১৩ ওয়ানডেতে মাত্র ছয়টি জয় পেয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। ইংল্যান্ডের কাছে সিরিজ হেরেছিল, ভারত–শ্রীলঙ্কার ত্রিদেশীয় সিরিজেও ফাইনালে উঠতে পারেনি তারা। অথচ বিশ্বকাপে সেই দুই দলকেই হারিয়ে ইতিহাসের সেরা পারফরম্যান্স দেখিয়েছে প্রোটিয়ারা। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে গ্রুপপর্বে ৬৯ রানে অলআউট হওয়ার পর সেমিফাইনালে একই প্রতিপক্ষকে ১২৫ রানে হারিয়ে প্রতিশোধও নিয়েছে দলটি।
পুরুষ দলের তুলনায় দক্ষিণ আফ্রিকার নারী ক্রিকেট এখনও বিকাশমান পর্যায়ে। পেশাদার কাঠামোতে আসার পর কেটেছে মাত্র এক যুগ। তবু এই সময়েই দেশটি ছয়টি ভিন্ন ফরম্যাট ও স্তরের ফাইনালে পৌঁছেছে। মাশিম্বিয়ি বলেন, “দক্ষিণ আফ্রিকায় ক্রিকেট এখন উন্নতির চমৎকার ধাপ পার করছে। ভুল থেকে শিখেই আমরা সামনে এগোচ্ছি।”
ফাইনালে আবারও ট্রফি না জিতলেও দক্ষিণ আফ্রিকা নারী দলের এই যাত্রা প্রমাণ করেছে—তারা শুধু সম্ভাবনাময় নয়, ধারাবাহিক উন্নতির পথে রয়েছে। হয়তো পরের আসরেই ‘চোকার্স’ তকমা ঝেড়ে ফেলে তারা লিখবে এক নতুন ইতিহাস।