অর্থনীতি ডেস্ক
চলতি অর্থবছরে অনলাইনে আয়কর রিটার্ন (ই-রিটার্ন) দাখিল বাধ্যতামূলক করার পরও প্রত্যাশিত সাড়া পাচ্ছে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ৩০ নভেম্বর ই-রিটার্ন জমার শেষ সময় ঘনিয়ে আসলেও এ পর্যন্ত জমা পড়েছে মাত্র ১০ লাখ ৯৮ হাজার ৮৮৫টি রিটার্ন, যা গত অর্থবছরের তুলনায় অনেক কম।
এনবিআরের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (টিআইএন)ধারীর সংখ্যা এক কোটি ২৩ লাখ। সে হিসেবে এখন পর্যন্ত মোট টিআইএনধারীর ৯ শতাংশেরও কম ব্যক্তি অনলাইনে রিটার্ন দাখিল করেছেন। অথচ ২০২৪–২৫ অর্থবছরে রিটার্ন অনলাইনে দাখিল বাধ্যতামূলক না থাকা সত্ত্বেও প্রায় ৪৫ লাখ রিটার্ন জমা পড়েছিল।
এনবিআরের প্রকাশিত সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত পাঁচ দিনে নতুন ই-রিটার্ন জমা হয়েছে এক লাখেরও কম। অথচ সময়সীমা শেষ হতে এখনও ২৬ দিন বাকি থাকলেও প্রতিদিন অন্তত এক লাখ রিটার্ন জমা পড়ার কথা ছিল। এই ধীরগতিতে রিটার্ন দাখিলের কারণে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে হঠাৎ চাপ সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
করদাতাদের অভিযোগ, ই-রিটার্ন প্রক্রিয়ায় একাধিক প্রযুক্তিগত সমস্যা দেখা দিচ্ছে। সার্ভারের দুর্বলতা, ওয়ান-টাইম পাসওয়ার্ড (ওটিপি) আসতে বিলম্ব, নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় জটিলতা, রিটার্নের প্রিভিউ ডাউনলোডে সমস্যা এবং কল সেন্টারে যোগাযোগ করেও যথাযথ সহায়তা না পাওয়া—এসব কারণে অনেকেই রিটার্ন দাখিলে বিলম্ব করছেন।
কর অঞ্চল-১২-এর করদাতা মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, “ই-রিটার্ন নামমাত্র আধুনিকায়ন। বিভিন্ন সেবা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে হাতে হাতে রিটার্নে দিতে হচ্ছে। যদি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে ই-রিটার্ন সার্ভারের সমন্বয় থাকত, তাহলে এই তথ্যগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংযুক্ত করা সম্ভব হতো।”
এনবিআরের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, শেষ সময়ের দিকে রিটার্ন জমা দেওয়ার প্রবণতা সাধারণত বেড়ে যায়। এ বছর অনেক নতুন করদাতা নিবন্ধন করেছেন, যারা ৩০ জুন পর্যন্ত স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে রিটার্ন জমা দিতে পারবেন। তাঁর ধারণা, শেষ পর্যন্ত রিটার্ন দাখিলের সংখ্যা গত বছরের তুলনায় কিছুটা বাড়বে।
এনবিআরের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেন, “ই-রিটার্ন সিস্টেম উন্নয়নে কাজ চলছে। এটি কেবল এনবিআরের একার পক্ষে সম্ভব নয়; অন্যান্য সংস্থার অংশগ্রহণও প্রয়োজন। ধীরে ধীরে সব প্রক্রিয়া সহজ হয়ে যাবে।”
যাদের জন্য অনলাইনে রিটার্ন বাধ্যতামূলক নয়
চলতি করবর্ষে (২০২৫–২৬) ৬৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সী প্রবীণ করদাতা, শারীরিকভাবে অসমর্থ বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তি, বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি করদাতা, মৃত করদাতার আইনগত প্রতিনিধি এবং বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি নাগরিকদের জন্য অনলাইনে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক নয়। তবে এদের মধ্যে কেউ চাইলে ই-রিটার্নের মাধ্যমে রিটার্ন জমা দিতে পারবেন।
যেসব করদাতা অনলাইনে রিটার্ন জমা দিতে সমস্যায় পড়ছেন, তারা ১৫ নভেম্বরের মধ্যে সংশ্লিষ্ট উপকর কমিশনারের কাছে কারণ উল্লেখ করে আবেদন করলে অতিরিক্ত বা যুগ্ম কর কমিশনারের অনুমোদনে কাগুজে রিটার্ন জমা দিতে পারবেন। এই সময়সীমা পূর্বনির্ধারিত ৩১ অক্টোবর থেকে ১৫ দিন বাড়ানো হয়েছে।
প্রতিনিধির মাধ্যমে ই-রিটার্ন জমার সুযোগ
এনবিআরের নির্দেশনা অনুযায়ী, করদাতার পক্ষে অনুমোদিত প্রতিনিধি ই-রিটার্ন জমা দিতে পারবেন। বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি করদাতারা ই-মেইলের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় তথ্য পাঠালে এনবিআর থেকে তাদের নিবন্ধন লিংক প্রদান করা হয়। এরপর তারা অনলাইনে আয়, ব্যয়, সম্পদ ও দায় সংক্রান্ত তথ্য দিয়ে ই-রিটার্ন জমা দিতে পারেন।
ই-রিটার্ন জমা সম্পন্ন হলে করদাতারা তাৎক্ষণিকভাবে জমা স্লিপ ও আয়কর সনদ প্রিন্ট করতে পারছেন। ফলে কাগুজে দলিল ছাড়াই দ্রুত ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় রিটার্ন দাখিলের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
তবে সার্বিকভাবে দেখা যাচ্ছে, বাধ্যতামূলক করা সত্ত্বেও করদাতাদের বড় অংশ এখনও অনলাইনে রিটার্ন দাখিলে অনীহা প্রকাশ করছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, করদাতাদের আস্থা অর্জন এবং প্রযুক্তিগত দুর্বলতা নিরসন ছাড়া এনবিআরের রাজস্ব আহরণে প্রত্যাশিত গতি আসবে না।