আন্তর্জাতিক ডেস্ক
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক ফেডারেল বিচারক বৃহস্পতিবার বোয়িং কোম্পানির বিরুদ্ধে দায়ের করা ৭৩৭ ম্যাক্স ৮ বিমানের মারাত্মক দুর্ঘটনাসংশ্লিষ্ট ফৌজদারি অভিযোগ খারিজের আদেশ দিয়েছেন। এটি মার্কিন বিচার বিভাগ ও বোয়িং-এর মধ্যে সম্পাদিত একটি সমঝোতা চুক্তির অংশ হিসেবে গৃহীত হয়।
চুক্তির অংশ হিসেবে বোয়িং কোম্পানি ১.১ বিলিয়ন ডলার প্রদান করবে, যার বিনিময়ে তাদের বিরুদ্ধে ৭৩৭ ম্যাক্স বিমানের সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগে দায়েরকৃত ফৌজদারি মামলাটি প্রত্যাহার করা হয়েছে। ফেডারেল আদালতের নথি অনুযায়ী, এই অর্থপ্রদান ও চুক্তির মাধ্যমে কোম্পানিটি মামলার আনুষ্ঠানিক বিচারিক প্রক্রিয়া থেকে অব্যাহতি পাচ্ছে।
টেক্সাসের ফোর্ট ওয়ার্থ আদালতে জুন মাসে মামলাটির বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা ছিল, তবে চুক্তি কার্যকর হওয়ায় তা বাতিল হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে সংঘটিত দুটি পৃথক বিমান দুর্ঘটনায় ৩৪৬ জন নিহতের ঘটনাকে ঘিরে বোয়িং-এর বিরুদ্ধে চলমান ফৌজদারি প্রক্রিয়ার পরিসমাপ্তি ঘটল।
২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে ইন্দোনেশিয়ার লায়ন এয়ার-এর ফ্লাইট এবং ২০১৯ সালের মার্চ মাসে ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট দুর্ঘটনায় পড়ে। দুটি ক্ষেত্রেই বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স ৮ মডেলের বিমান ব্যবহৃত হয়েছিল। দুর্ঘটনাগুলোতে যথাক্রমে ১৮৯ ও ১৫৭ জন যাত্রী ও ক্রু নিহত হন। তদন্তে দেখা যায়, বিমানের স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, বিশেষ করে “ম্যানুভারিং ক্যারেক্টারিস্টিকস অগমেন্টেশন সিস্টেম” (এমসিএএস), ত্রুটিপূর্ণভাবে সক্রিয় হয়ে বিমানের ভারসাম্য নষ্ট করেছিল, যা দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়।
বোয়িং কোম্পানি পূর্বে এই ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে জানিয়েছিল, তারা নিরাপত্তা ও মান নিয়ন্ত্রণে উন্নতি আনতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বৃহস্পতিবার দেওয়া এক বিবৃতিতে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, “আমরা বিচার বিভাগের সঙ্গে আমাদের চুক্তির সব শর্ত পূরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। পাশাপাশি, নিরাপত্তা, মান ও সম্মতি প্রক্রিয়াগুলো আরও জোরদার করতে আমাদের চলমান প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।”
মার্কিন বিচার বিভাগ গত ২৩ মে বোয়িং-এর সঙ্গে এই সমঝোতা চুক্তি ঘোষণা করে। এর ফলে প্রতিষ্ঠানটিকে ফৌজদারি দায় স্বীকার করতে হচ্ছে না, তবে ভবিষ্যতে নিরাপত্তা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে স্বচ্ছতা বাড়াতে নির্দিষ্ট শর্ত মেনে চলতে হবে।
চুক্তির সমালোচনাও উঠেছে। নিহত যাত্রীদের পরিবারের সদস্যরা ও তাঁদের প্রতিনিধিরা চুক্তিকে বোয়িং-এর জন্য “অত্যন্ত সুবিধাজনক” বলে মন্তব্য করেছেন। তাঁদের দাবি, এই সমঝোতা প্রকৃত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং এর মাধ্যমে করপোরেট দায়বদ্ধতার উদাহরণ ক্ষুণ্ণ হয়েছে। বাদীপক্ষের আইনজীবী জাভিয়ের ডি লুইস বলেন, “এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের বড় কোম্পানিগুলোর কাছে ভুল বার্তা যাচ্ছে—যে তারা নিরাপত্তাকে উপেক্ষা করেও দায়মুক্তি পেতে পারে।”
বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স সিরিজের বিমানগুলো ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপী নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। দীর্ঘ প্রযুক্তিগত পরিবর্তন ও সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়ার পর ২০২১ সালে পুনরায় বাণিজ্যিক ফ্লাইটে ফিরে আসে এই মডেল। তবে দুর্ঘটনাগুলোর পর থেকে বোয়িং-এর ভাবমূর্তি ও আর্থিক অবস্থায় বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে, এবং কোম্পানিটি এখনও বিভিন্ন দেশে দেওয়ানি মামলার সম্মুখীন।
বিমান নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে, এই চুক্তি বোয়িং-এর বিরুদ্ধে ফৌজদারি ঝুঁকি কমালেও প্রতিষ্ঠানটির ওপর নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও আন্তর্জাতিক এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের নজরদারি আরও বাড়বে। ভবিষ্যতে বিমান সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়ায় কঠোর মানদণ্ড প্রয়োগের বিষয়েও এই সিদ্ধান্ত একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে।