অর্থনীতি ডেস্ক
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) আইন পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে ‘বেসামরিক বিমান চলাচল (সংশোধন) অধ্যাদেশ–২০২৫’-এর খসড়া জনমতের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। তবে বেবিচক মনে করছে, প্রস্তাবিত অধ্যাদেশের বেশ কিছু ধারা কার্যকর হলে দেশের বিমান নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে জটিলতা তৈরি হতে পারে এবং আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা (আইকাও) কর্তৃক পরিচালিত নিরাপত্তা মূল্যায়নে বাংলাদেশ ঝুঁকির মুখে পড়বে।
সম্প্রতি বেবিচক মন্ত্রণালয়ে তাদের পর্যবেক্ষণ জমা দিয়েছে, যেখানে প্রস্তাবিত সংশোধনীর বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তারিত মতামত প্রদান করা হয়েছে।
বেবিচকের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ২০১৭ সালের বিদ্যমান বেসামরিক বিমান চলাচল আইনের ১৪ ধারায় বেবিচক চেয়ারম্যানকে বিমান নিরাপত্তা–সংক্রান্ত নির্দেশ, আদেশ ও বিজ্ঞপ্তি জারি ও সংশোধনের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই ক্ষমতা আন্তর্জাতিক মান ও আইকাও–নির্ধারিত বিধান অনুযায়ী প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। ফলে আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে নতুন নিয়ম বা সংশোধন বাস্তবায়ন সম্ভব হয়।
কিন্তু প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে রুলস অব বিজনেসের ১৪(ক) অনুচ্ছেদ অনুসরণের কথা বলা হয়েছে, যেখানে কোনো সময়সীমা নির্ধারণ নেই। এতে করে আইকাও–নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সংশোধন সম্পন্ন করা কঠিন হবে এবং বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মান রক্ষায় পিছিয়ে পড়তে পারে।
বেবিচকের মতে, আইকাও সাধারণত নতুন নিয়ম বা সংশোধনের প্রস্তাব পাঠানোর সময় সদস্য রাষ্ট্রগুলোর জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়। সেই সময়সীমা অতিক্রম করলে প্রস্তাব স্বয়ংক্রিয়ভাবে গৃহীত হয় এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তা কার্যকর করা বাধ্যতামূলক। নতুন অধ্যাদেশে অনুমোদন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হলে এই সময়সীমা রক্ষা করা সম্ভব হবে না। এর ফলে আইকাও বাংলাদেশকে “গুরুতর নিরাপত্তা উদ্বেগের দেশ” (Significant Safety Concern) হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে, যা দেশের বিমান খাতের জন্য বড় ধাক্কা হবে।
বেবিচক তাদের পর্যবেক্ষণে সুপারিশ করেছে যে, বিদ্যমান আইন, ২০১৭–এর ১৪ ধারা অপরিবর্তিত রাখা প্রয়োজন। বর্তমান ব্যবস্থায় চেয়ারম্যান দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং তা আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
বেবিচকের একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রস্তাবিত সংশোধন কার্যকর হলে বেবিচকের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা সীমিত হবে। এতে বিমান নিরাপত্তা–সংক্রান্ত বিধান তৈরিতে বিলম্ব এবং আইকাও–এর নিরীক্ষায় বাংলাদেশের কার্যকারিতা দুর্বল হবে। পাশাপাশি, প্রযুক্তিগত বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন প্রয়োজন হলে দ্রুত বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হবে।
প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে ট্রাভেল এজেন্সি–সংক্রান্ত নতুন বিধান নিয়েও আপত্তি জানিয়েছে বেবিচক। খসড়া পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ট্রাভেল এজেন্সি আইন, ২০১৩ অনুযায়ী বিষয়টি ইতোমধ্যে নিয়ন্ত্রিত। নতুন অধ্যাদেশে একই বিধান যুক্ত হলে আইনগত দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হবে। তাই বিদ্যমান আইন বহাল রাখার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি।
বেবিচক জানিয়েছে, বর্তমানে প্রচলিত আইনেই বিমান চলাচল নিরাপত্তা, যাত্রীসেবা ও প্রযুক্তিগত বিধিবিধান আন্তর্জাতিক মানে রক্ষা করা সম্ভব। ফলে নতুন অধ্যাদেশের প্রয়োজনীয়তা পুনর্বিবেচনা করা উচিত।
পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, ২০১৭ সালের আইনের কাঠামো অক্ষুণ্ণ রেখে চেয়ারম্যানের হাতে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বহাল থাকলে বিমান নিরাপত্তা, প্রশাসনিক দক্ষতা ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বজায় থাকবে।
এ বিষয়ে অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার ও এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ এটিএম নজরুল ইসলাম বলেন, “২০১৭ সালে গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে আইনটি সংসদে পাস হয়। এখন তড়িঘড়ি করে সংশোধনের প্রয়োজন কেন হলো তা স্পষ্ট নয়। চেয়ারম্যানের ক্ষমতা কমে গেলে বিষয়টি আইকাও–এর নিয়মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে। যেহেতু আইনটি সংসদে অনুমোদিত, তাই সংশোধনে তাড়াহুড়ো না করে সতর্কভাবে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।”
বেবিচকের পর্যবেক্ষণে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে বিদেশি বিমান সংস্থাগুলোর বাংলাদেশে কার্যক্রম তদারকির বিষয়টি স্পষ্ট নয়। বর্তমানে বিদেশি সংস্থাগুলো শতভাগ দেশীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানকে সাধারণ বিক্রয় প্রতিনিধি (জিএসএ) হিসেবে নিয়োগ দেয়, যার মাধ্যমে স্থানীয় জনবল কর্মসংস্থান, দক্ষতা বৃদ্ধি ও বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হয়।
নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী, বিদেশি বিমান সংস্থাগুলো চাইলে নিজস্ব অফিস স্থাপন করতে পারবে বা একাধিক জিএসএ নিয়োগ দিতে পারবে। এতে তাদের কার্যক্রম তদারকি দুর্বল হবে এবং মনিটরিং জটিলতা বাড়বে। বেবিচক মনে করে, এই বিষয়টি পরিষ্কার না হলে ভবিষ্যতে নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা কঠিন হবে।
সংস্থাটি মনে করে, আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচলের মান বজায় রাখতে এবং বাংলাদেশের বিমান খাতের নিরাপত্তা ও সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখতে প্রস্তাবিত অধ্যাদেশের ধারাগুলো পুনর্বিবেচনা জরুরি।