আন্তর্জাতিক ডেস্ক
জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে জাপানের অর্থনীতি ০.৪ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। সরকারি পরিসংখ্যানে প্রকাশিত এ তথ্য দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সামগ্রিক দুর্বলতাকে আরও স্পষ্ট করেছে। পূর্বাভাস অনুযায়ী সংকোচন ০.৬ শতাংশ হবে বলে ধারণা করা হলেও বাস্তব সংকোচন তার চেয়ে কম হলেও এটি ২০২৪ সালের প্রথম প্রান্তিকের পর প্রথম নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, অভ্যন্তরীণ ভোক্তা ব্যয় এবং ব্যবসায়িক বিনিয়োগের মন্থরতা অর্থনীতির এই সংকোচনের প্রধান কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক চাপ, মুদ্রাস্ফীতি এবং চাহিদা হ্রাসও জাপানের সামগ্রিক অর্থনৈতিক গতিশীলতায় প্রভাব ফেলেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে নতুন নীতিগত উদ্যোগ ও আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন হতে পারে।
অক্টোবরে জাপানের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন সানায়ে তাকাচি। দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে লক্ষ্য রেখে একটি নতুন প্রণোদনা প্যাকেজ তৈরির নির্দেশ দেন। সরকার–সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, প্যাকেজটির পরিমাণ ১৭ ট্রিলিয়ন ইয়েনের বেশি হতে পারে, যা বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী ১১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি। অর্থমন্ত্রী সাতসুকি কাতায়ামা জানান, দেশীয় ভোক্তা ব্যয় পুনরুজ্জীবিত করা, ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা এবং আন্তর্জাতিক বাজারের চাপ মোকাবিলায় এই প্যাকেজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। মন্ত্রিসভা আসন্ন শুক্রবার প্রণোদনা প্যাকেজটির অনুমোদন দেবে বলে আশা করা হচ্ছে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, জাপানের অর্থনীতির ওপর চলমান ভূরাজনৈতিক উত্তেজনাও ঝুঁকি তৈরি করছে। ক্যাপিটাল ইকোনমিক্সের বিশ্লেষক মার্সেল থিয়েলিয়্যান্ট সতর্ক করে বলেছেন, তাইওয়ান সম্পর্কিত প্রধানমন্ত্রী তাকাচির সাম্প্রতিক মন্তব্যের কারণে চীনের সঙ্গে টানাপোড়েন একটি বিস্তৃত বাণিজ্য বিরোধে রূপ নিতে পারে। তাঁর মতে, চীন বিরল খনিজ রপ্তানিতে সীমাবদ্ধতা আরোপ করলে জাপানের শিল্প খাত—বিশেষ করে প্রযুক্তি ও স্বয়ংচালিত শিল্প—তীব্র চাপের মুখে পড়তে পারে। তিনি আরও উল্লেখ করেন, জাপানি গাড়ি নির্মাতারা ইতোমধ্যেই চীনা বৈদ্যুতিক গাড়ির দ্রুত উত্থানের কারণে প্রতিযোগিতামূলক চাপে আছে; নতুন কোনো নিষেধাজ্ঞা তাদের অবস্থানকে আরও দুর্বল করতে পারে।
পার্লামেন্টে গত ৭ নভেম্বর তাকাচি বক্তব্য দেন যে, তাইওয়ানে সশস্ত্র হামলা হলে যৌথ আত্মরক্ষার অধীনে সেখানে সেনা পাঠানোর সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এই মন্তব্যের পর দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক উত্তেজনা আরও তীব্র হয়। প্রতিক্রিয়ায় চীন ও জাপান পরস্পরের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে। পাশাপাশি চীন তার নাগরিকদের জাপান ভ্রমণে সতর্ক থাকার পরামর্শ প্রদান করে, যা দুই দেশের জনগণ এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রমের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
ঐতিহাসিকভাবে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত কয়েক দশক তাইওয়ান জাপানের অধীনে ছিল। তবে বর্তমান ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় বেইজিং দাবি করছে যে তাইওয়ান তাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ, এবং প্রয়োজনে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার কথাও পুনর্ব্যক্ত করে আসছে। এই অবস্থানকে কেন্দ্র করে চীন ও জাপানের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই কৌশলগত সন্দেহ, আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং সামরিক ব্যয় নিয়ে টানাপোড়েন বিরাজমান। যদিও দুই দেশই গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদার, তবুও পারস্পরিক অবিশ্বাসের কারণে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক প্রায়শই চাপের মুখে পড়ে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, বৈশ্বিক অর্থনীতির অনিশ্চয়তা, আঞ্চলিক উত্তেজনা এবং অভ্যন্তরীণ ভোক্তা চাহিদা হ্রাস—এসব মিলিয়ে জাপানের সামনে আগামী মাসগুলোতে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। প্রণোদনা প্যাকেজটি অর্থনীতিতে কিছুটা গতি আনতে পারে, তবে সামগ্রিক পুনরুদ্ধার বেশিরভাগই নির্ভর করবে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি, জাপান–চীন সম্পর্কের স্থিতিশীলতা এবং বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনের ওপর।