আন্তর্জাতিক ডেস্ক
পাকিস্তানের উত্তরপশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ খাইবার পাখতুনখোয়ায় সেনা ও পুলিশের যৌথ নিরাপত্তা বাহিনী দুই দিনব্যাপী সমন্বিত অভিযানে তেহরিক-ই তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি)-এর অন্তত ৩০ জন সদস্যকে হত্যার দাবি করেছে। দেশটির সেনাবাহিনীর আন্তঃবিভাগ সংযোগ দপ্তর আইএসপিআর এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতির মাধ্যমে এ তথ্য জানিয়েছে।
আইএসপিআর জানায়, ১৮ ও ১৯ নভেম্বর খাইবার পাখতুনখোয়ার লাক্কি মারওয়াত, মোহামান্দ, টাঙ্ক এবং কুররম—এই চার জেলায় পৃথক অভিযান চালানো হয়। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে পরিচালিত এসব অভিযানে সবচেয়ে বেশি সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে কুররম জেলায়, যার সংখ্যা ১২ জন। নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, নিহতদের সবাই টিটিপির দুটি সক্রিয় গ্রুপের সদস্য এবং দীর্ঘদিন ধরে সীমান্তবর্তী এলাকায় সহিংস তৎপরতায় জড়িত ছিল।
পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী টিটিপিকে ‘ফিৎনা আল খারিজি’ নাম দিয়ে উল্লেখ করে বলেছে, সাম্প্রতিক সময়ে সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বৃদ্ধি পাওয়ায় অভিযানের মাত্রা বাড়ানো হয়েছে। যৌথ বাহিনীর দাবি, অভিযানের মাধ্যমে টিটিপির কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি দুর্বল হয়ে পড়বে এবং ভবিষ্যৎ হামলার ঝুঁকি কমবে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তানের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল বিশেষভাবে সন্ত্রাসবাদ-সংক্রান্ত সহিংসতার মুখে পড়েছে। ২০২১ সালে আফগানিস্তানে তালেবান সরকার প্রতিষ্ঠার পর থেকে সীমান্তবর্তী খাইবার পাখতুনখোয়া এবং বেলুচিস্তানে সন্ত্রাসী হামলা ও নাশকতার ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। খাইবার পাখতুনখোয়া ঐতিহাসিকভাবে টিটিপির শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত, যেখানে বিচ্ছিন্ন গ্রামাঞ্চল ও দুর্গম পাহাড়ি এলাকার কারণে গোষ্ঠীটির কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে, বেলুচিস্তানে সক্রিয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন বালোচ লিবারেশন আর্মি (বিএলএ) সাম্প্রতিক সময়ে হামলা বৃদ্ধি করেছে।
একটি ইসলামাবাদভিত্তিক গবেষণা সংস্থার সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ২০২৫ সালের ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত তিন মাসে পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সহিংসতার হার আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় ৪৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ওই সময় দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে ৩২৯টি সহিংস ঘটনা ঘটে, যেখানে প্রাণহানি হয়েছে অন্তত ৯০১ জনের এবং আহত হয়েছেন আরও ৫৯৯ জন। এ ধরনের সহিংসতার ধারাবাহিক বৃদ্ধি নিরাপত্তা বাহিনীকে ক্রমাগত চাপের মুখে ফেলেছে।
এ ছাড়া পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় পুলিশ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত শুধুমাত্র খাইবার পাখতুনখোয়াতেই ৬ শতাধিক সন্ত্রাসী হামলা সংঘটিত হয়েছে। এসব হামলায় নিহত হয়েছেন ৭৯ জন পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্য এবং ১৩৮ জন বেসামরিক নাগরিক। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, সীমান্তের ভৌগোলিক জটিলতা, আফগানিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং স্থানীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বিস্তৃত নেটওয়ার্কসহ বিভিন্ন কারণ সন্ত্রাসবাদ দমনে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
নিরাপত্তা বাহিনীর সাম্প্রতিক অভিযানের মাধ্যমে সন্ত্রাসী তৎপরতা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে কর্তৃপক্ষ আশা করছে। তবে একই সঙ্গে তারা সতর্ক করেছে, টিটিপি ও অন্যান্য গোষ্ঠীর ভাঙাগড়া এবং নতুন জোটবদ্ধতার ফলে ভবিষ্যতেও হামলার ঝুঁকি বিদ্যমান থাকবে। ফলে সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে গোয়েন্দা নজরদারি এবং সমন্বিত নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা আরও বাড়ছে।
এই দুই দিনের অভিযানের মাধ্যমে টিটিপির বেশ কয়েকটি সক্রিয় গ্রুপ দুর্বল হলেও, পরিস্থিতির সামগ্রিক উন্নতির জন্য দীর্ঘমেয়াদি কৌশল গ্রহণ এবং সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে সন্ত্রাসবাদবিরোধী অভিযান অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়ে বলা হয়েছে, দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত এমন অভিযান চলবে।