জাতীয় ডেস্ক
দেশের ভবনগুলোর প্রায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বড় মাত্রার ভূমিকম্পের সঙ্গে সম্ভাব্য অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি বড় ধরণের ক্ষয়ক্ষতির কারণ হতে পারে। এছাড়া, নির্মাণকালে কাঠামোগত দুর্বলতা এবং বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) অনুযায়ী না নির্মাণের ফলে ঝুঁকি আরও বাড়ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ভূমিকম্পের প্রবণতা বেড়েছে। সর্বশেষ ২১ নভেম্বর সকালে রাজধানীতে ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পসহ পরপর ছোট আঘাতকারী ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ভূমিকম্প চলাকালীন আতঙ্কিত না হওয়ার কিছু পরামর্শ দিয়েছে।
ভূমিকম্প মোকাবিলার প্রস্তুতি হিসেবে ফায়ার সার্ভিস চলতি বছরের মে মাসে রাজধানীর মিরপুরে অপারেশনাল টিম স্থানান্তর করেছে। বড় ধরনের ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে দ্রুত উদ্ধার কার্যক্রম নিশ্চিত করতে ৬০ সদস্যের স্পেশাল কুইক রেসপন্স টিম গঠন করা হয়েছে, যারা পূর্বাচলে রাখা হয়েছে। এছাড়া ঢাকার বাইরের আটটি বিভাগীয় শহরে ২০ সদস্যের করে মোট ১৬০ জনের স্পেশাল টিম তৈরি করা হয়েছে। এই টিমগুলো ভূমিকম্প, অগ্নিকাণ্ড ও অন্যান্য দুর্যোগের সময় দ্রুত রেসপন্স করতে সক্ষম।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল জানান, ভূমিকম্পের সঙ্গে সম্ভাব্য সব সরকারি সেবা যেমন বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ও সুয়ারেজ লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ভবন ধ্বস ও হতাহতের পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিসের জনবল, সরঞ্জাম ও স্টেশন সংখ্যা ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরের প্রয়োজন অনুযায়ী পর্যাপ্ত নয়।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (প্রশিক্ষণ, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) লে. কর্নেল এম এ আজাদ আনোয়ার উল্লেখ করেন, ভূমিকম্প অপ্রত্যাশিতভাবে ঘটতে পারে এবং কোনো পূর্বসঙ্কেত নেই। রাজউকের ২০১৮–২০২২ সালের স্টাডি অনুযায়ী, ঢাকা শহরে ৭.৫ রিখটার স্কেলের ভূমিকম্প হলে প্রায় ছয় লাখ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং ১.৫–২ লাখ মানুষ নিহত হতে পারে। এ পরিস্থিতিতে সার্চ ও রেসকিউ অপারেশন করা অত্যন্ত কঠিন হবে।
ভূমিকম্পের সময় করণীয় সম্পর্কে তিনি জানান, হাইরাইজ বিল্ডিংয়ে থাকলে কলাম বা বিমের সংযোগস্থলে আশ্রয় নেওয়া উচিত। মাথার ওপরে বালিশ বা কুশন দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। জরুরি অবস্থায় শুকনো খাবার, পানি, রেডিও, টর্চ, ব্যাটারি ইত্যাদি ‘ইমার্জেন্সি প্যাক’ হিসেবে প্রস্তুত রাখা প্রয়োজন। যেসব মানুষ নীচু তলায় থাকেন, তারা সম্ভাব্য হলে খোলা জায়গায় চলে যেতে পারেন।
সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ফায়ার সার্ভিস বিভিন্ন ডকুমেন্টারি প্রচার করছে এবং প্রশিক্ষিত ৫৮ হাজার ভলান্টিয়ার তৈরি করেছে, যারা ভূমিকম্প বা অন্যান্য দুর্যোগের সময় সাহায্য করবে। উদ্ধার কাজে ব্যবহৃত সরঞ্জামগুলো পূর্বাচল, মিরপুর ও সিদ্দিকবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে বিতরণ করা হয়েছে, যাতে কোনো একটি অঞ্চলে ক্ষতি হলে অন্য স্থান থেকে দ্রুত রেসপন্স করা যায়।
তবে লে. কর্নেল এম এ আজাদ আনোয়ার সীমাবদ্ধতাও উল্লেখ করেন। কোনো বড় ভূমিকম্পে হাজার হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হলে একক বাহিনী দিয়ে কার্যকর রেসকিউ অপারেশন পরিচালনা করা সম্ভব নয়। এজন্য দেশের বিভিন্ন বাহিনী, ভলান্টিয়ার ও সাধারণ জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশ এবং আশপাশের অঞ্চল ভারতীয়, ইউরেশিয়ান ও বার্মিজ প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থান করছে, যা দেশকে ভূমিকম্পপ্রবণ করে তুলেছে। ঘনবসতিপূর্ণ শহরের অপরিকল্পিত অবকাঠামোর কারণে বড় ধরনের ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। ২০০৯ সালের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও জরিপ অনুযায়ী, ঢাকায় ৭ বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্পে প্রায় ৭২ হাজার ভবন ধ্বসে পড়বে এবং ১ লাখ ৩৫ হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ভূমিকম্প গবেষক ও সাবেক উপাচার্য সৈয়দ হুমায়ুন আখতার ২০১৬ সালের গবেষণায় উল্লেখ করেছেন, ঢাকা মেট্রোপলিটনের এক শতাংশ ভবন বিধ্বস্ত হলেও ৬০০০ ভবন ধ্বস্ত হবে, এবং অন্তত ৩ লাখ মানুষ সরাসরি হতাহত হতে পারে। ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধার ও সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হলে আরও বেশি মানুষের জীবন ঝুঁকিতে পড়বে।