জাতীয় ডেস্ক
জুলাই অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত ঘটনাবলি নথিবদ্ধ করার লক্ষ্যে তৈরি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ‘মনসুন প্রোটেস্ট আর্কাইভস’-এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল বুধবার সকালে রাজধানীর বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্ল্যাটফর্মটির যাত্রা শুরু ঘোষণা করা হয়। প্ল্যাটফর্মটি অভ্যুত্থানকালীন বিভিন্ন অডিও–ভিডিও ফুটেজ, ছবি, সাক্ষ্য এবং ঘটনার স্থান–কালসংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণ করে একটি সমন্বিত ও যাচাইকৃত ডাটাবেস গড়ে তুলতে কাজ করছে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক দপ্তরের বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হুমা খান বলেন, ইতিহাস সংরক্ষণ ও সত্যনিষ্ঠ নথি প্রণয়নে এ ধরনের উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তিনি উল্লেখ করেন, আর্কাইভটি তথ্যকে বস্তুনিষ্ঠভাবে সংরক্ষণ করার একটি কার্যকর উপায় হিসেবে কাজ করবে। তাঁর মতে, সংঘটিত ঘটনার সঠিক তথ্য, প্রমাণ ও প্রাসঙ্গিক উপাদান সংরক্ষিত থাকলে ভবিষ্যতে বিভিন্ন গবেষণা, নীতিনির্ধারণ ও মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট মূল্যায়নে তা সহায়ক হবে।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মটি তিনটি মানবাধিকার ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আর্কাইভে জুলাই অভ্যুত্থানের সময় ক্ষতিগ্রস্ত বা ভুক্তভোগী ৯৩৩ জন ব্যক্তির যাচাইকৃত তথ্য সংরক্ষিত হয়েছে। এছাড়া প্ল্যাটফর্মটিতে আট হাজারের বেশি অডিও–ভিডিও উপাদান, ঘটনার স্থান ও সময়ের বিশদ বিবরণ, আহতদের অবস্থা, নিহত ব্যক্তিদের মৃত্যুর কারণ এবং সংশ্লিষ্ট বাহিনীর পরিচিতি–সংক্রান্ত তথ্য ডিজিটাল ফরম্যাটে সংগৃহীত রয়েছে। তথ্যগুলো একটি ভৌগোলিক মানচিত্রভিত্তিক ভিজ্যুয়াল প্রদর্শনীর মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে, যাতে ব্যবহারকারীরা ঘটনাগুলো স্থানিকভাবে বুঝতে পারেন।
অনুষ্ঠানে হুমা খান, সাংবাদিক ও গবেষক ডেভিড বার্গম্যান, জুলাই অভ্যুত্থানে নিহত মোহাম্মদ হৃদয়ের বোন জেসমিন আক্তার এবং উদ্যোগটির বাংলাদেশ প্রধান ফৌজিয়া আফরোজ অংশগ্রহণে একটি প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনায় বক্তারা তথ্যসংরক্ষণ, যাচাইযোগ্য প্রমাণ উপস্থাপন এবং ডিজিটাল নথিভুক্তির আন্তর্জাতিক মান নিয়ে বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। তাঁরা বলেন, সংঘটিত ঘটনার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ সংরক্ষণ ভবিষ্যৎ তদন্ত, বিচারপ্রক্রিয়া ও ইতিহাসরচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
অনুষ্ঠানে আর্কাইভের ওয়েবসাইট কার্যক্রমের একটি সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনা প্রদর্শন করা হয়। পাশাপাশি দুটি অনুসন্ধানী তথ্যচিত্র—“গাজীপুর: এভিডেন্স অব আ মার্ডার” এবং “অ্যানাটমি অব বিজিবি শুটিং ইন রামপুরা”—প্রদর্শিত হয়। প্রথম তথ্যচিত্রে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গাজীপুরে মোহাম্মদ হৃদয়ের মৃত্যুর ঘটনাটি ফরেনসিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। দ্বিতীয় তথ্যচিত্রে রামপুরায় সংঘটিত গুলিবর্ষণের পরিস্থিতি ও ঘটনার ক্রমিক বিবরণ উপস্থাপন করা হয়। তথ্যচিত্র দুটি আর্কাইভের প্রাপ্ত উপকরণ ও মাঠপর্যায়ের অনুসন্ধানের উপর ভিত্তি করে নির্মিত, যা ঘটনার ধারাবাহিকতা ও সম্ভাব্য প্রমাণের ব্যবহারযোগ্যতা তুলে ধরেছে।
জুলাই অভ্যুত্থানের এক সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন, আন্দোলনে নারী–পুরুষ নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি উল্লেখ করেন, নারী অংশগ্রহণকারীদের সাহস, স্বতঃস্ফূর্ততা ও নেতৃত্ব আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাঁর মতে, ডিজিটাল আর্কাইভটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য তথ্যভান্ডার হিসেবে কাজ করবে, যেখানে সংরক্ষিত উপাদানগুলো ঘটনার সার্বিক প্রেক্ষাপট বুঝতে সহায়ক হবে।
অনুষ্ঠানে মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ, গবেষক, বিভিন্ন পেশাজীবী, অভ্যুত্থানের সময় সক্রিয় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরা এবং নিহত ও আহতদের পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা আর্কাইভটির মাধ্যমে ঘটনার যাচাইকৃত ও নথিবদ্ধ ইতিহাস সংরক্ষণকে একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রয়োজনীয় উদ্যোগ হিসেবে দেখেন। এ ধরনের তথ্যসংরক্ষণ ভবিষ্যতে মানবাধিকার সুরক্ষা, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শক্তিশালীকরণ এবং আইনি কাঠামোর উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।