আন্তর্জাতিক ডেস্ক
চার বছর ধরে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের স্থবির পরিস্থিতির মধ্যেই ইউক্রেনে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। অন্যদিকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি জানান, নির্বাচন আয়োজনসংক্রান্ত আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে সংসদে আলোচনা চলছে এবং এ বিষয়ে বিদেশি মিত্রদের অযথা চাপ প্রদান সমীচীন নয়। এ সময় দুই দেশের ভিন্নমুখী অবস্থান চলমান সংঘাতের কূটনৈতিক সমাধানের ওপর নতুন চাপ সৃষ্টি করেছে।
রাশিয়ার আগ্রাসনের শুরু থেকে ইউক্রেনের অভ্যন্তরে নির্বাচন স্থগিত রয়েছে। বুধবার ওয়াশিংটনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, ইউক্রেনে দীর্ঘদিন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে না এবং দেশটির জনগণ দ্রুত নির্বাচন দেখতে আগ্রহী। তার মতে, চলমান সংঘাতের সমাধান ছাড়া ইউক্রেনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অগ্রসর করা সম্ভব নয়। তিনি মনে করেন, শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের মাধ্যমেই নির্বাচন আয়োজনের সুযোগ তৈরি হবে।
ট্রাম্পের এই মন্তব্য ইউক্রেন সরকারের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছে। তবে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন যে, নির্বাচন আয়োজন একটি সংবেদনশীল জাতীয় বিষয় এবং তা সংবিধান ও বিদ্যমান আইন অনুযায়ী সংসদীয় আলোচনার মাধ্যমেই নির্ধারিত হবে। তিনি বলেন, ইউক্রেনের অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্তে বাহ্যিক হস্তক্ষেপ দেশটির সার্বভৌমত্বের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ইউক্রেনের মিত্ররাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে তার আলোচনায় জাতীয় আইন ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে।
জেলেনস্কি জানান, তিনি সংসদ-সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিদের সঙ্গে নির্বাচন আয়োজনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। দেশটি বর্তমানে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে; ফলে নির্বাচন পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা, অবকাঠামো এবং প্রশাসনিক প্রস্তুতি নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আন্তর্জাতিক সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ হলেও, ইউক্রেনের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নিজেদের সংবিধান অনুযায়ীই এগোবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
এদিকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হচ্ছে। গত বুধবার ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় পোকরোভস্ক শহরের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের দাবি করেছে রাশিয়া। দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই শহরে রুশ বাহিনী স্থল অভিযানে অগ্রগতি অর্জন করেছে। তবে কিয়েভ দাবি করেছে, পোকরোভস্কের বড় অংশেই ইউক্রেনীয় বাহিনী এখনো প্রতিরোধ গড়ে রেখেছে এবং রুশ সেনাদের একাধিক হামলা সফলভাবে প্রতিহত করা হয়েছে।
রাশিয়া আরও জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ইউক্রেনের ১৪৬টি এলাকায় বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে। এসব হামলার লক্ষ্য ছিল জ্বালানি স্থাপনা, পরিবহন অবকাঠামো, ড্রোন উৎক্ষেপণ কেন্দ্র এবং সামরিক ঘাঁটি। এর পাশাপাশি দেশটি ১০২টি ইউক্রেনীয় ড্রোন ভূপাতিত করার কথাও জানিয়েছে। এসব হামলা ইউক্রেনের জ্বালানি সরবরাহ ও লজিস্টিক সক্ষমতার ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে ইউক্রেন পাল্টা অভিযানে রাশিয়ার একটি তেলবাহী ট্যাংকার, একটি ট্যাঙ্ক, একটি সাজোয়া যান এবং ২৫টি আর্টিলারি সিস্টেম ধ্বংসের দাবি করেছে। দেশটি জানিয়েছে, পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলীয় ফ্রন্টলাইনে গত একদিনে ১৭৭টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। তীব্র এই মেরুকরণ দুই দেশের সামরিক তৎপরতার মাত্রা বৃদ্ধি এবং যুদ্ধের প্রসারিত ধারাবাহিকতার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
এর আগে রাশিয়া-নিয়ন্ত্রিত খেরসন অঞ্চলের একটি হাসপাতালে ইউক্রেনীয় গোলাবর্ষণে তিনজন নিহত এবং দুজন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে মস্কো। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে বেসামরিক স্থাপনায় হামলা আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচনের ইস্যু সামনে আসায় ইউক্রেন যুদ্ধের কূটনৈতিক অগ্রগতির পথে নতুন জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং আইনগত কাঠামো নিশ্চিত না হলে যুদ্ধকালীন নির্বাচন অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সমর্থন ধরে রাখা এবং জনগণের আস্থাকে শক্তিশালী রাখা ইউক্রেন সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২০১৯ সালে ইউক্রেনে সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ২০২২ সালে রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন শুরু হলে দেশব্যাপী জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। বর্তমান আইনি কাঠামো অনুযায়ী যুদ্ধ চলমান থাকলে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন সম্ভব নয়। ফলে যুদ্ধক্ষেত্রের অগ্রগতি, শান্তি আলোচনা এবং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক চাপ—সবকিছুই মিলিয়ে ইউক্রেনের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চিত অবস্থায় রয়েছে।