আন্তর্জাতিক ডেস্ক
রাশিয়া থেকে সম্ভাব্য নিরাপত্তা হুমকি নিয়ে উদ্বেগ বাড়তে থাকায় পোল্যান্ডের পূর্ব সীমান্ত জোরদারে একটি প্রকল্পে সহায়তার জন্য জার্মানি সীমিত সংখ্যক সেনা পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে। জার্মান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই সেনারা মূলত প্রকৌশলভিত্তিক কাজের মাধ্যমে পোল্যান্ডের প্রতিরক্ষা অবকাঠামো শক্তিশালী করতে সহযোগিতা করবেন। ইউরোপীয় নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে চলমান উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে এ সিদ্ধান্তকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
জার্মান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বার্লিনে এক বিবৃতিতে জানান, পোল্যান্ডে মোতায়েন জার্মান সেনাদের প্রধান দায়িত্ব হবে বিভিন্ন ধরনের ইঞ্জিনিয়ারিং কার্যক্রম পরিচালনা করা। এসব কাজের মধ্যে দুর্গ নির্মাণ, পরিখা খনন, কাঁটাতারের বেড়া স্থাপন এবং সম্ভাব্য ট্যাংক প্রতিরোধক অবকাঠামো তৈরির মতো কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, জার্মান সেনাদের সহায়তা কেবল এসব প্রযুক্তিগত ও নির্মাণমূলক কাজেই সীমাবদ্ধ থাকবে এবং তারা কোনো সরাসরি সামরিক সংঘাতে জড়িত হবেন না।
মুখপাত্র সেনা মোতায়েনের সুনির্দিষ্ট সংখ্যা উল্লেখ না করলেও জানান, এটি হবে মাঝারি মাত্রার দুই অঙ্কের একটি দল। ধারণা করা হচ্ছে, এই সেনারা ২০২৬ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিক থেকে কাজ শুরু করে ২০২৭ সালের শেষ পর্যন্ত প্রকল্পে যুক্ত থাকবেন। এই সময়সীমার মধ্যে পোল্যান্ডের পূর্ব সীমান্তে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন কাঠামোগত উন্নয়ন সম্পন্ন করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
জার্মান কর্তৃপক্ষ আরও জানিয়েছে, এই সেনা মোতায়েনের জন্য দেশটির পার্লামেন্টের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে না। কারণ, সংশ্লিষ্ট সেনাদের জন্য কোনো তাৎক্ষণিক সামরিক সংঘাতের ঝুঁকি নেই। জার্মান আইনি কাঠামো অনুযায়ী, বিদেশে সেনা পাঠানোর ক্ষেত্রে সাধারণত পার্লামেন্টের অনুমোদন প্রয়োজন হলেও, সরাসরি যুদ্ধ বা সংঘাতের আশঙ্কা না থাকলে কিছু ব্যতিক্রমের সুযোগ রয়েছে। এই প্রকল্পকে সেই ব্যতিক্রমের আওতায় বিবেচনা করা হয়েছে।
পোল্যান্ড দীর্ঘদিন ধরেই ইউরোপের পূর্ব সীমান্তে একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে। দেশটি বেলারুশ ও রাশিয়ার কালিনিনগ্রাদ অঞ্চলের সঙ্গে দীর্ঘ সীমান্ত ভাগ করে নিয়েছে। এই ভূগোলগত বাস্তবতার কারণে পোল্যান্ড তাদের সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদারে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আসছে। গত বছরের মে মাসে পোল্যান্ড সরকার পূর্ব সীমান্তের বিস্তৃত অংশ শক্তিশালী করার একটি পরিকল্পনা প্রকাশ করে, যার লক্ষ্য ছিল সম্ভাব্য সামরিক ও নিরাপত্তা ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রস্তুতি বৃদ্ধি করা।
২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার আগ্রাসনের পর থেকে পোল্যান্ড ইউক্রেনের অন্যতম দৃঢ় সমর্থকে পরিণত হয়েছে। ওয়ারশ কিয়েভকে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং সামরিক সহায়তা দিয়ে আসছে। একই সঙ্গে পোল্যান্ড ইউক্রেনের পশ্চিমা মিত্রদের সরবরাহ করা অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম পরিবহনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট রুট হিসেবে কাজ করছে। এই ভূমিকার কারণে দেশটি নিজস্ব নিরাপত্তা ঝুঁকিও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে পোল্যান্ড সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের সশস্ত্র বাহিনী আধুনিকায়নের ওপর জোর দিয়েছে। প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো হয়েছে এবং নতুন অস্ত্র ও প্রযুক্তি সংযোজনের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর সক্ষমতা উন্নত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সীমান্ত অবকাঠামো শক্তিশালী করাও এই বৃহত্তর কৌশলের অংশ।
জার্মানির এই সহায়তা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে নিরাপত্তা সহযোগিতার একটি উদাহরণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের পর জার্মানি বর্তমানে ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। দেশটি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, সাঁজোয়া যানসহ বিভিন্ন ধরনের সামরিক সরঞ্জাম ইউক্রেনে পাঠিয়েছে। পোল্যান্ডে সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদারে জার্মান সেনাদের প্রকৌশল সহায়তা ইউরোপের পূর্বাঞ্চলে প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি আরও সুসংহত করবে বলে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই উদ্যোগের মাধ্যমে পোল্যান্ড ও জার্মানির মধ্যে সামরিক সহযোগিতা আরও গভীর হতে পারে এবং তা ইউরোপীয় নিরাপত্তা কাঠামোর ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে। একই সঙ্গে এটি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ইউরোপে যে নিরাপত্তা পুনর্বিন্যাস চলছে, তারই একটি অংশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।